নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে তথ্য-উপাত্তের অপঘাত চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আগে দেশে তথ্য-উপাত্তের নৈরাজ্য ছিল, এরপর শুরু হয় অন্ধত্ব। এখন দেখা যাচ্ছে, তথ্য-উপাত্তের অপঘাত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে সম্প্রতি যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, এটা তারই প্রমাণ।’
মঙ্গলবার রাজধানীর নয়াপল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজনে সংগঠনটির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মোয়াজ্জেম হোসেন স্মারক বক্তৃতায় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, একদিকে তথ্য লুকিয়ে রাখা হবে, আরেক দিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার চিন্তা করা হবে, এ দুটি সাংঘর্ষিক। তিনি উল্লেখ করেন, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকেরা তথ্য পাচ্ছেন না; কিন্তু ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের তথ্য দেয়া হলে বাজারে প্রভাব পড়ে; জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়।
তথ্যের অপঘাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনামের হানি হচ্ছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, ‘তথ্য-উপাত্তের বড় উৎস বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের আগে রপ্তানি-আমদানিসহ আর্থিক সূচকের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম আমরা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তথ্য কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না; ব্যবসায়ীরা তথ্য পাচ্ছে অথচ সাংবাদিকেরা পাচ্ছে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, এটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। অথচ সাংবাদিকদের সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তথ্য প্রকাশিত হলে কি বড় ধরনের নাশকতা হবে? অর্থনৈতিক সাংবাদিকেরা কি নাশকতাকারী? সাংবাদিকদের উদ্দেশে দেবপ্রিয় বলেন, ‘আপনারা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে তথ্য-উপাত্তের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছে, এর মধ্য দিয়ে আপনাদের সম্মান জানানো হচ্ছে।’
জনপ্রতিনিধিদেরও তথ্য দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, তারাও তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধিকার পান না। সাংবাদিকদের চেয়ে তাদের দুঃখ কম নয়। জনপ্রতিনিধিদের যেহেতু দুর্বলতা আছে, সেহেতু আমলাদের সামনে বড়গলায় কথা বলতে পারেন না তারা। দেশের নীতি-নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে গেছে মনে করে তিনি বলেন, নীতি ব্যাখ্যা করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না।
দেশে নীতি সমন্বয়ের অভাব আছে বলে অভিযোগ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি আরও বলেন, এ সমন্বয়হীনতা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দেয়ার পরও একটি ব্যাংকের মালিকানা বদল হয়ে গেল কেন, এ প্রসঙ্গে এমন কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘মুদ্রানীতি ও আর্থিকনীতি সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে। এটা দূর করতে হবে। একইভাবে মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদহারেও নমনীয়তা আনতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এখন শোনা যাচ্ছে রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে স্থানীয়
শিল্পমালিকরা বিদেশে শিল্পের কাঁচামাল কিনছেন। এভাবে ২ বা ৩ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো যাবে না। এক্ষেত্রে আরও নমনীয় হতে হবে। সুদহারেও নমনীয়তা আনতে হবে। মুদ্রানীতি ও আর্থিকনীতি সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে, সেটা দূর করতে হবে অর্থনীতির স্বার্থে।’
দেবপ্রিয় আরও বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চারটি ঘাটতি রয়েছে। ফলে জিডিপির আনুপাতিক হারে রাজস্ব আয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বোয়িংয়ের চলার মতো।
সরকারের বিনিয়োগ থেকে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। আমাদের দ্বিতীয় ঘাটতি হলো রাজস্ব আয়ে। জিডিপি বাড়লেও আনুপাতিক হারে রাজস্ব আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। আবার বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে। অতিমূল্যায়িত প্রকল্প গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এতদিন গর্বের সঙ্গে দাবি করত যে দেনা পরিশোধে কখনও খেলাপি হয়নি। সে দাবি এখন আর থাকছে না। ঋণ পরিশোধ করতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জ্বালানির বিল, বৈদেশিক কোম্পানির মুনাফা, বিদেশি এয়ারলাইন্সের পাওনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫ বিলিয়ন ডলার যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।’
ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের পরিচালনায় ও সংগঠনের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মৃধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ।