মাহমুদুল হক আনসারীঃনগর ও নাগরিক নিয়ে শহরজীবন। কৃত্রিম এ জীবনে নগরবাসীর অপরিহার্য সঙ্গী পানি। বিশুদ্ধ পানাহার ও গৃহস্থালির কাজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পানির প্রয়োজনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। নগরজীবনে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা আছে। থাকবে, আরও বাড়বে। শহর এলাকা সম্প্রসারিত হচ্ছে। নতুন নতুন বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। ওয়াসা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে সেটিই জনপ্রত্যাশা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তবু ৩০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বোর্ডে অনুমোদন করেছে। গ্রাহকের কাছে পানি বিক্রি করে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা লাভ করে আসছে। অথচ পানির দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে সংস্থাটি। গত এক দশকে ৯ বার পানির দাম বাড়িয়েছে সেবা সংস্থাটি। এবারও আবাসিক গ্রাহকদের জন্য এক লাফে ৩০ শতাংশ পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। লাভে থাকা সত্ত্বেও আবার পানির দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গ্রাহক ও বিশেষজ্ঞরা। গ্রাহকেরা বলছেন, ওয়াসা লোকসানে চললে কথা ছিল। কিন্তু সংস্থাটি প্রতিবছরই পানি বিক্রি করে লাভ করছে। ফলে পানির দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের কাঁধে আরও চাপ সৃষ্টি করার যৌক্তিকতা নেই। বর্তমানে আবাসিক বাসাবাড়ির গ্রাহকেরা এক হাজার লিটার পানি ১৮ টাকায় পাচ্ছেন। বাণিজ্যিক বা অনাবাসিক গ্রাহকেরা একই পরিমাণ পানির জন্য ওয়াসাকে দিচ্ছেন ৩৭ টাকা। অথচ রাজধানী শহরের আবাসিক গ্রাহকেরা ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে এক হাজার লিটার পানি কিনছেন ১৫ টাকা দরে। অর্থাৎ ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে ওয়াসার পানির দাম বেশি। ঢাকা ওয়াসা এক হাজার লিটার পানি ১৫ টাকায় সরবরাহ করছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা নিচ্ছে ১৮ টাকা। এখন আবার দাম বাড়াতে চায় সংস্থাটি। এটা সমর্থন করছেন না কোনো গ্রাহক। নগরীর বাসিন্দা মুক্তিযুদ্ধা এসএম শামসুল আলম চৌধুরী বলেন, সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে ওয়াসার আবার পানির দাম বাড়লে নগরজীবনে অর্থকষ্ট বাড়বে। লাখ লাখ ভাড়াটিয়া বাসাবাড়িতে ভাড়ায় বাস করে। ঘরের মালিক এই সুযোগে বাসাভাড়া বাড়িয়ে দেবে। ফলে ভাটিয়ার অর্থ চাপ আরেকবার বাড়বে। এই বিষয়গুলো অবশ্যই মাথায় রাখা চায়। বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসা এক হাজার লিটার পানি ১৫ টাকায় সরবরাহ করছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা নিচ্ছে ১৮ টাকা। এখন আবার দাম বাড়াতে চায়, এটা সমর্থন করা যায় না। তিনি বলেন, অবৈধ সংযোগ ও চুরির কারণে অনেক পানি নষ্ট হচ্ছে। দুর্নীতি ও অপচয় না কমিয়ে গ্রাহকের কাঁধে দামের বোঝা চাপানো উচিত নয়। দাম বাড়ানোর সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে গত ২৭ মার্চ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছে, আবাসিকে ৩০ শতাংশ ও বাণিজ্যিকে ৫০ শতাংশ পানির দাম বাড়ানো যেতে পারে। এই প্রতিবেদন বোর্ডে অনুমোদন হয়ে এখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে। মন্ত্রণালয় যেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চট্টগ্রাম নগরের ৮০ লাখ মানুষের কষ্টের ভাগী হয়। বর্তমান মুল্যস্ফীতির কথা চিন্তা করে মন্ত্রণালয় আশা করি সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে। সম্প্রতি পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম ফজলুল্লাহ গণমাধ্যমে বলেন, পানি পরিশোধনে ব্যবহƒত রাসায়নিক দ্রব্য, বিদ্যুৎ বিল, জনবলের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয় উৎপাদন খরচের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ছাড়া পানি সরবরাহে ঋণের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। তাই পানির উৎপাদন খরচ এখন বেড়ে গেছে। বর্তমানে ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ সাত হাজার ৭৬৭টি। নগরের প্রায় এক হাজার ২০০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়। ১৮ টাকায় (এক হাজার লিটার) পানি বিক্রি করেও ওয়াসা লাভে আছে। ফলে নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কারিগরি অপচয় কমিয়ে আনা গেলে সে টাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যেত বলে মন্তব্য নগরবাসীর। চট্টগ্রাম ওয়াসার লাভের হিসাব ভালো।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী সংস্থার নিট মুনাফা বা লাভ ছিল ছয় কোটি ২৭ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল আট কোটি পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ২১ কোটি ১৯ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৯ কোটি ৮৪ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬১ কোটি ৯৩ লাখ নিট মুনাফার হিসাব দেয়া হয়েছে ওয়াসার বাজেট প্রতিবেদনে। ওয়াসার পানি নিয়মিত আসে না। অনেক সময় পানিতে ময়লা পাওয়া যায়। বর্তমানে যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তাও লবণাক্ত। ফলে মান না বাড়িয়ে দাম বাড়ানোর দিকেই ঝোঁক ওয়াসার। জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০৮ কোটি ৫৪ লাখ ৯ হাজার টাকা, মোট রাজস্ব ব্যয় ২৪৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ফলে সংশোধিত বাজেটে মোট লাভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রাক্কলনে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৪৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। মোট রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭০ কোটি চার লাখ টাকা। ফলে প্রাক্কলিত বাজেটে মোট লাভের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৭৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। নিট লাভের পরিমাণ ১১ কোটি ১১ লাখ টাকা। লাভে থাকায় সংস্থাটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎসাহ বোনাস বা প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগও নিয়েছে। গত বছর নিয়মিত বেতন-ভাতার বাইরে দুটি করে মূল বেতন বিশেষ পুরস্কার হিসেবে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। গত এক দশকে ৯ বার পানির দাম বাড়িয়েছে সেবা সংস্থাটি। এবারও আবাসিক গ্রাহকদের জন্য এক লাফে ৩০ শতাংশ পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সেদিকে নজর নেই কর্তৃপক্ষের। পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর প্রায় প্রতিবছরই সমালোচনার মুখে পড়ে ওয়াসা। গ্রাহকেরা পানির মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে গরম এলে পানির উৎপাদন কমে যায়। পানি যতটুকু আসে, ততটুকুও লবণাক্ত। বাধ্য হয়ে গ্রাহকদের কেনা পানি পান করতে হয়। এ বছর ১০ মার্চ থেকে উৎপাদন এক ধাক্কায় সাত থেকে আট কোটি লিটার কমে যায়। বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকদের অভিযোগ, নিয়মিত পানি পাচ্ছেন না তারা। লবণাক্ততার জন্য হালিশহর, উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা, কাটগড়, বাকলিয়া, কর্নেলহাট, আকবর শাহ, পাহাড়তলীসহ একাধিক এলাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। হালিশহর সরাইপাড়ার বাসিন্দারা বলেন, ওয়াসার পানি নিয়মিত আসে না। অনেক সময় পানিতে ময়লা পাওয়া যায়। বর্তমানে যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তাও লবণাক্ত। ফলে মান না বাড়িয়ে দাম বাড়ানোর দিকেই ঝোঁক ওয়াসার। মাঝখানে ২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে পানির দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু এর পরের বছরই দুই দফা দাম বাড়ানো হয়েছে। পানির দাম বাড়লেও সেবা বাড়েনি বলে অভিযোগ করেন উত্তর কাট্টলীর ইঞ্জিনিয়ার মাসুম আল মাহমুদ নোমায়ের। এখনও তার এলাকায় নিয়মিত পানি যায় না। অথচ এসব দেখার কেউ নেই। এ বিষয়ে ওয়াসার এমডি বলেন, দূরবর্তী এলাকাগুলোয় পানির কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে না। কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। এ কারণে উৎপাদন এক ধাক্কায় সাত থেকে আট কোটি লিটার কমেছে। লাভে থেকেও আরেক দফা দাম বাড়ানো অযৌক্তিক বলে মনে করেন ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, ১৮ টাকায় (এক হাজার লিটার) পানি বিক্রি করেও ওয়াসা লাভে আছে। ফলে নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কারিগরি অপচয় কমিয়ে আনা গেলে সে টাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যেত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি অপচয় কমাতে এখনও সক্ষমতা অর্জন করেনি। এ ছাড়া অবৈধ সংযোগ এবং পানি চুরির নানা অনিয়ম তো আছেই। ওয়াসা নগরবাসীর সুপেয় পানির সংকট পূরণ করতে পারেনি। বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তি এখনও অনেক এলাকার জন্য মহাসংকট আর ভোগান্তি বয়ে আনবে। তবুও ওয়াসার এই সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে অনেক শ্রেণির মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট চিকিৎসক সমাজ গবেষক, ডাক্তার ও মনিরুজ্জামান। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কথা মাথায় রেখে অপরাপর পণ্যের মতো মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পানির দাম বাড়ানো থেকে সরে আসার দাবি সাধারণ জনগণের।
মাহমুদুল হক আনসারী
সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট