মিথ্যা ঘোষণায় আসছে অরিস সিগারেট ও ফিল্টারের পেপার

রহমত রহমান: ঘোষণা ছিল ‘সিনথেটিক স্টেপলে ফাইবার অব পলিস্টার’, যার শুল্ককর মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ আমদানি হয়েছে ‘সেলুলোজ অ্যাসিটেট টো’, যা দিয়ে তৈরি হয় সিগারেট তৈরির ফিল্টার। যার মোট শুল্ককর প্রায় ৫৮ শতাংশ। আবার আমদানির ঘোষণা দেয়া হয়েছে ‘পিই কোটেড পেপার’। কিন্তু এই পেপারের সঙ্গে আমদানি হয়েছে সাত টনের বেশি ‘অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপার বা সিগারেট ফয়েল পেপার’। এই সিগারেট ফয়েল পেপারে বিদেশি সিগারেট ব্র্যান্ড ‘অরিস’ মুদ্রিত রয়েছে। অরিসসহ কয়েক ব্র্যান্ডের সিগারেট বর্তমানে অবৈধভাবে দেশে তৈরি ও বাজারজাত হচ্ছে, এতে বিপুল পরিমাণ শুল্ককর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। শুধু সিগারেট পেপার নয়, সিগারেট তৈরির সরঞ্জামও আমদানি করা হয়েছে। একটি চক্র মিথ্যা ঘোষণায় এসব সিগারেট পেপার ও সরঞ্জাম দীর্ঘদিন ধরে আমদানি করে আসছে। এনবিআরের হিসাবে, বিদেশি এসব সিগারেটের বাজার ৭-৮ শতাংশ। প্রতিনিয়ত এই বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে এই সিগারেট উৎপাদনে ব্যবহƒত সরঞ্জাম আমদানি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে তেমন উদ্যোগ নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এনবিআর সূত্রমতে, চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার আমদানিকারক ইউনিভার্সেল করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি ৫ মার্চ চীন থেকে ‘সিনথেটিক স্টেপলে ফাইবার অব পলিস্টার’ ঘোষণায় পণ্য আমদানি করে। পণ্য খালাসে চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মহসিন জামান অ্যান্ড কোং লিমিটেড ২ এপ্রিল বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। সিনথেটিক স্টেপলে ফাইবার অব পলিস্টার হলো এক ধরনের অ্যাঁশ বা ফাইবার, যা দিয়ে সুতা, কার্পেট, নরম খেলনা, বালিশ প্রভৃতি তৈরি হয়। তবে পণ্য চালানটি মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা হয়েছে, এতে শুল্ককর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে বলে তথ্য পায় এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। ফলে চালানটির খালাস স্থগিত করা হয়। সম্প্রতি সিআইসি, কাস্টম হাউসের এআইআর শাখা ও এনবিআরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়।

কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠান ৫৫০৩২০০০ এইচএস কোডে ২৫ হাজার ২৬৯ কেজি ‘সিনথেটিক স্টেপলে ফাইবার অব পলিস্টার’ ঘোষণা দিয়েছে। এই পণ্যের শুল্ককর মাত্র ৫ শতাংশ। কিন্তু কায়িক পরীক্ষায় পাওয়া গেছে ২৫ হাজার ২৬৯ কেজি ‘সেলুলোজ অ্যাসিটেট টো’। ‘সেলুলোজ অ্যাসিটেট টো’ দিয়ে সিগারেটের ফিল্টার তৈরি হয়। এই পণ্যের এইচএস কোড-৫৫০২১০০০ এবং মোট শুল্ককর ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি এক পণ্য ঘোষণা দিয়ে অন্য পণ্য বা কম শুল্কের পণ্য ঘোষণা দিয়ে উচ্চ শুল্কের পণ্য আমদানি করেছে। এনবিআর এবং সিআইসির কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, দেশে যেসব অবৈধ সিগারেট (অরিস, ইজি স্পেশাল গোল্ড, মন্ড, স্ট্রবেরিসহ বিলাসী সব সিগারেট) তৈরি ও বাজারজাত হচ্ছে, এসব ফাইবার দিয়ে সেসব সিগারেটের ফিল্টার তৈরি করা হচ্ছে। একটি চক্র মিথ্যা ঘোষণায় সুযোগ বুঝে এসব পণ্য আমদানি করছে। তবে তদারকির দুর্বলতার কারণে বের হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ৭-৮ শতাংশ বাজার এসব অবৈধ সিগারেটের দখলে রয়েছে। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

কাস্টমস গোয়েন্দার একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, ফাইবার ঘোষণায় সিগারেটের ফিল্টার তৈরির ফাইবার আমদানি। এটা ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে দেখছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। শুল্ককর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করা এই আমদানিকারকের প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন করে মতামত দিতে কাস্টমস গোয়েন্দাকে অনুরোধ করেছে কাস্টম হাউস। এতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা পণ্যের গুদাম, পণ্যের ব্যবহার ও সিগারেট তৈরির ফিল্টার আমদানির সামগ্রিক বিষয় উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। তবে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের যোগসাজশে এই পণ্য আমদানি হয়েছে বলে মনে করেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে চেষ্টা করেও ইউনিভার্সেল করপোরেশনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ইউনিভার্সেল করপোরেশনের পণ্য খালাসের দায়িত্বে ছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মহসিন জামান অ্যান্ড কোং। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. মহসিন মিথ্যা ঘোষণায় নিজেদের সম্পৃক্তার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা জেনেশুনে মিথ্যা ঘোষণা দেব কেন? পণ্যের মালিক আমাদের যে ডকুমেন্ট দেয়, তা আমরা সাবমিট করি। আমরা তো জানি না কনটেইনারের মধ্যে কী আছে। তিনি বলেন, এই কোম্পানির আইআরসি দেখলে বুঝতে পারবেন যে, তারা আর কখনও আমদানি করেনি। প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করা হয়েছে, তারা জবাব দেবে। প্রতিষ্ঠান জরিমানা দিয়েই পণ্য নিতে চাচ্ছে। তবে যে ফাইবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সেই ফাইবার আর সিগারেটের ফিল্টার তৈরির ফাইবার দেখতে একই রকম বলে দাবি করেন তিনি। যোগসাজশের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমি কখনও মিথ্যা ঘোষণার পণ্য খালাস করি না। এই প্রতিষ্ঠানকে আমি চিনতাম না। আমাদের একজন এই কাগজ এনে দিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ আমরা আগে কখনও করিনি।

অন্যদিকে, চট্টগ্রামের আমদানিকারক এ কে এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি চীন থেকে ‘পিই কোটেড পেপার’ ঘোষণায় পণ্য আমদানি করে। খালাসের জন্য ১৬ এপ্রিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট একতা ক্লিয়ারিং এজেন্সিস লিমিটেড বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। ২১ হাজার ৮১৫ কেজি পিই কোটেড পেপারের মূল্য দেখানো হয় ২১ হাজার ৮১৫ ডলার। কিন্তু আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করেছে বলে তথ্য পায় এনবিআরের সিআইসি। তথ্য যাচাই করে চালানটি খালাস স্থগিত করা হয়। ৬ মে চালানটির বিষয়ে সিআইসি থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে চিঠি দেয়া হয়। এছাড়া চালানটি বিশেষ নিরাপত্তা হেফাজতে রাখতে কাস্টম হাউসকে অনুরোধ করা হয়। ৭ মে সিআইসি প্রতিনিধি, এআইআর কর্মকর্তা, সিঅ্যান্ডএফ ও বন্দর নিরাপত্তা সদস্যের উপস্থিতিতে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়।

এতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানের ঘোষিত ২১ হাজার ৮১৫ কেজি পিই কোটেড পেপারের জায়গায় ১৬ হাজার ৭২৮ কেজি পিই কোটেড পেপার পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের ঘোষণার চেয়ে ৫ হাজার ৮৭ কেজি কম পাওয়া গেছে। তবে ৭ হাজার ৫৬০ কেজি ‘অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপার’ বা ৭ টন সিগারেট ফয়েল পেপার পাওয়া গেছে। এই সিগারেট ফয়েল পেপার মূলত অরিস সিগারেট ব্র্যান্ডের। এই সিগারেট ফয়েল পেপার ঘোষণা বর্হিভূতভাবে প্রতিষ্ঠান আমদানি করেছে।

কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘোষণাবর্হিভূত আমদানি করা সিগারেট ফয়েল পেপারে বিদেশি সিগারেট অরিস ব্র্যান্ড মুদ্রিত রয়েছে। দেশে মূসক নিবন্ধিত সিগারেট উৎপাদনকারী কোনো প্রতিষ্ঠান এই ব্র্যান্ডের সিগারেট উৎপাদন হয় না। একজন বাণিজ্যিক আমদানিকারক হিসেবে এই ব্র্যান্ডের সিগারেটের কাঁচামাল আমদানির বিষয়টি উদ্বেগজনক। এসব পণ্য নকল সিগারেট উৎপাদন করার কাজে ব্যবহƒত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের যোগসাজশে অসত্য ঘোষণায় এসব পেপার আমদানি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কায়িক পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এ কে এন্টারপ্রাইজ শুধু এখন নয়, দীর্ঘদিন ধরে সিগারেট তৈরির উপকরণ আমদানি করে আসছে। ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি সিগারেট তৈরির পেপার আমদানি করেছে। সর্বশেষ ১৬ এপ্রিল পিই কোটেড পেপার আমদানি করেছে। যদিও এই পণ্যের আড়ালে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপার আমদানি করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি কয়েকবার সিগারেট তৈরির ফিল্টার (সেলুলোজ অ্যাসিটেট টো) আমদানি করেছে। আরও কিছু সিগারেট তৈরির উপকরণ আমদানি করেছে। আমরা ধারণা করছি, প্রতিষ্ঠানটি মিথ্যা ঘোষণায় অরিসসহ অন্যান্য বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট তৈরির উপকরণ আমদানি করে আসছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।

এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, দেশে ৭-৮ শতাংশ বাজার অবৈধ সিগারেটের দখলে। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এসব সিগারেট তৈরি হচ্ছে। মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা পণ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব সিগারেট। এনবিআর চেয়ারম্যান এসব সিগারেট তৈরির উপকরণ আমদানি, তৈরি ও বাজারজাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। কাস্টমস, গোয়েন্দা সংস্থা তদারকি বাড়ালে এসব সিগারেট তৈরির উপকরণ আমদানি, বাজারজাত রোধ করা সম্ভব হবে।

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০