মানবতা বর্মী সেনাদের পদতলে

সোনিয়া খান লিমা: সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নাম ‘রোহিঙ্গা’। নিয়তির কী নির্মম পরিণতি, শত শত বছর ধরে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী তাদের নিজ আবাসভ‚মিতে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর তাণ্ডব শুরুর এক মাস পরও প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের কিছু তল্লাশি চৌকিতে হামলার অজুহাতে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। এখন পর্যন্ত প্রায় চার লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। তাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরে রয়েছে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সেখানে দেখা দিয়েছে মারাত্মক স্যানিটেশন সমস্যা। নেই বিশুদ্ধ পানি; গোসল তো দূরের কথা। ক’দিনের টানা বৃষ্টিতে সবখানে নোংরা পরিবেশ। দুর্গন্ধ বাতাসে। এ অবস্থায় সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গা-আশ্রিত উখিয়া-টেকনাফের এলাকায়। তারা আক্রান্ত হচ্ছে সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, জ্বর, ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ নানা রোগে। সু চি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বললেও এখনও তা রুদ্ধ। এখন বিশ্বমোড়লদের দিকে চেয়ে আছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের মতো একটি দেশে বিপুলসংখ্যক এ জনগোষ্ঠীর চাপ সহ্য করা খুবই দুরূহ ও যুক্তিহীন। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রতি উদারতা দেখিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা বস্তিতে নানা রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় দেখা গেছে  বৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। কোথাও জমাট পানি। পরিবেশ এমন যে, সেখানে কোনো মানুষের বাস করা কঠিন।

শিশু ও পুরুষরা তো এখানে-সেখানে মলমূত্র সেরে নিচ্ছেন; কিন্তু মহিলাদের কষ্টের সীমা নেই। তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে রাতের আঁধারের জন্য। প্রতি তাঁবুতে রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। অবস্থা এমন হয়েছে জরুরিভাবে ব্যবস্থা না নিলে রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্তের ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

আক্রান্তরা আশ্রয়স্থল কিংবা অনেক দূরে মেডিক্যাল ক্যাম্পে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মেডিক্যাল ক্যাম্পের চিকিৎসক ও স্বাস্থকর্মীরা রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। চিকিৎসা নিতে আসাদের মাঝে ডায়রিয়া, চর্মরোগ ছাড়াও অনেক য²া রোগী পাওয়া যাচ্ছে। অনেকের ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস বি, সি, জাতীয় রোগ ধরা পড়ছে। কক্সবাজার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের মাঝে এ পর্যন্ত ২৬ জন পোলিও, ১৬ জন হাম ও অসংখ্য চর্মরোগী পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা গোসল করতে পারছেন না। ফলে তাদের শরীরের দুর্গন্ধে পরিবেশ ভারি হওয়ার উপক্রম। সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ৩৬টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। ক্যাম্পগুলো থেকে এক লাখ ২০ হাজার হামের টিকা, ৪০ হাজার পোলিও ভ্যাকসিন, ৩৮ হাজার ভিটামিন ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। ১৫ বছরের নিচে সবাইকে হামের টিকার পাশাপাশি অন্যান্য টিকাও দেওয়া হচ্ছে। এ-ছাড়া বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা রয়েছে চলমান।

রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের অব্যাহত নিপীড়ন ও দেশত্যাগে বাধ্য করার ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে শিশু ও নারীরা। স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, এখন অবধি প্রায় এক হাজার ১২৮টি পরিবার-বিচ্ছিন্ন শিশুর সন্ধান পাওয়া গেছে। শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এ সংখ্যা। নারীদের মধ্যে অন্তত ১৬ হাজার অন্তঃসত্ত¡া। তাদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। পালানোর সময় পথেই অনেক নারী সন্তান প্রসব করেছেন। এ-ছাড়াও আশ্রয় নেওয়া সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় জš§ হয়েছে অসংখ্য শিশুর। পারাপারের সময় নৌযানেও অনেকে সন্তান প্রসব করেছেন।

জাতিসংঘের সুরক্ষা বিভাগের প্রধান জ্যঁ লিবি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই মানবিক সংকট ক্রমশ বড় হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী শরণার্থীদের মোট সংখ্যার ৬০ শতাংশই শিশু। এসব শিশু এখন ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা প্রয়োজন, সে সঙ্গে প্রয়োজন মানসিক সহায়তা।’

ব্যাপকসংখ্যক যৌন নির্যাতনের শিকার নারী চরম শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় রয়েছেন। মিয়ানমার সেনাকর্তৃক নারী গণধর্ষণের উদ্দেশ্য অঞ্চলটি থেকে মুসলিম বিতাড়নের পাশাপাশি তাদের ঘরে বৌদ্ধ সন্তান জন্ম দেওয়া। এটিকে তারা ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে; সে টার্গেটেই নারীদের ওপর চড়াও হচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা বৃদ্ধ, শিশু ও নারীরা পানিবাহিত রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ঢল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে এখন ক্যাম্পগুলোয় সুপেয় পানি ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা জরুরি। প্রয়োজন উচ্চমানের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার।

মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি। তাদের প্রতি আরও যথাযথ ভ‚মিকা পালনের সুযোগ ও দায়িত্ব রয়েছে বিশ্বের কল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলোরও।

প্রতিদিনই ব্যক্তি-উদ্যোগে বহু মানুষ ত্রাণ নিয়ে আসছে। তবে কোনোভাবেই সে ত্রাণ রোহিঙ্গাদের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। ত্রাণ বিতরণেও সৃষ্টি হচ্ছে নানা বিশৃঙ্খলা। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে কিছু ত্রাণ এলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। যদিও বাস্তুচ্যুতদের জন্য যুক্তরাজ্যের একটি সাহায্য সংস্থা শুক্রবার সকালে ৮৫ টন ত্রাণ পাঠিয়েছে। এ-ছাড়া ফিনল্যান্ড ও নরওয়ের রেডক্রস যৌথভাবে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসায় ৫৯ টন চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছে। দুদিনে ১৮৩ টন ত্রাণ এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুক্রবার পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ, সাহায্য সংস্থা, রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট এক হাজার ৫৪৫ টন ত্রাণ চট্টগ্রামে পাঠিয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে ভারত, চীন, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ব্রিটেন, জাপান, ইরান, ফিনল্যান্ড ও নরওয়ে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ গ্র্যান্ডির আশঙ্কা, এ সংকট আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, ‘যে কোনো সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ সমস্যা সমাধানে রাস্তা খুঁজতে হবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের কাছে রোহিঙ্গাদের অমানবিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক রিপোর্টে রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন রোহিঙ্গা ইস্যুটি সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপর হওয়া উচিত। কারণ রোহিঙ্গারা গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, এমনকি সিঙ্গাপুরেও রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা কারও কারও মতে দুই মিলিয়ন হতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ যা করতে পারে, তা বাংলাদেশ কিংবা বিচ্ছিন্নভাবে কোনো রাষ্ট্র পারে না। প্রশ্ন হলো জাতিসংঘের ভ‚মিকা নির্জীব কেন? ওআইসির মতো সংস্থার কী অবদান আছে? রাবেতা নামে যে সাহায্য সংস্থা আছে, তাদের কিছু কার্যক্রম দেখা গেলেও তা যথেষ্ট নয়। বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন এ দেশে বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। সমাজবহিভর্‚ত হয়ে গেলে যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, তাদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের প্রতি বাংলাদেশের আবেদন মিয়ানমারের সংখ্যালঘুদের আশ্রয়দানের জন্য। যদিও বাংলাদেশ সরকার মানবতার খাতিরে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেফ জোন’ চালুরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। সে ব্যাপারেও মিয়ানমার কোনো সাড়া দেয়নি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। সে দেশের ফার্স্টলেডি বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে গেছেন। কিন্তু সমাধানের এখনও কোনো রাস্তা বের হয়নি। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় হতবাক হলেও অং সান সু চিকে তেমন কোনো চাপ দিচ্ছে না।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মিয়ানমার সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আন্তর্জাতিক পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল। অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান সেনা দমন-পীড়নে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে এ সমস্যা সমাধানে ‘আগ্রহ’ দেখিয়েছেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। সু চি বলেছেন, ‘কিছুসংখ্যক শরণার্থীকে ফেরত নেবে তার দেশ। তবে যাচাই-বাছাই শেষে তাদের ফেরত নেওয়া হবে। এটা যে কোনো সময় শুরু হতে পারে। সেনা অভিযানের মুখে চার লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসার বিষয়ে আরও খোঁজ নেওয়ার কথা জানান তিনি। চীন ও ভারত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে; কিন্তু অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে দুটি দেশই মিয়ানমার সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। হাজার বছর ধরে বাস করেও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অবৈধ বাসিন্দা! জীবন, সম্ভ্রম আর সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর স্বজন হারানো লাখ লাখ মুখ আজ আশ্রয় ক্যাম্পে বন্দিজীবন পার করছে। মানবতার চরম লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত রেখেছে মিয়ানমার সরকার। তাই শুধু মানবিক সহানুভ‚তি ও ত্রাণ-খয়রাত দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের আপ্রাণ ও নিরলস সহায়তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবিক সহায়তা দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে এ মানবিক সহায়তা দিন দিন হয়ে পড়ছে চ্যালেঞ্জময়।

রোহিঙ্গা সমস্যায় জর্জরিত হলে আমাদের সার্বিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। কেননা এ সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র মিয়ানমারই।

 

শিক্ষার্থী, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

sonia.tabassum113Ñyahoo.com

 

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০