রজত রায়: আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিভিন্ন কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান কবে হবে, তা অনিশ্চিত। ফলে আগামী বছরও উচ্চমূল্যস্ফীতির প্রবণতা থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করাটা বেশ জটিল এবং বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।
বহু ক্ষেত্রেই আমরা উন্নতি করছি। আয়, প্রত্যাশিত গড় আয়ু ও সাক্ষরতার হার বেড়েছে, পরিবহন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির বহু দিকের উন্নতি ঘটেছে। বেসরকারি ক্ষেত্রের কিছু অংশ টগবগ করছে, প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, ডিজিটাল ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সূচকেরও উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমলেও আয়বৈষম্য বেড়েছে। বেড়েছে ভোগবৈষম্য। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এতে প্রমাণিত হয়, দেশের সম্পদের একটি বড় অংশ কিছু মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে। একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনাভাইরাস মহামারির বৈরী প্রভাবের পরও দেশের দারিদ্র্যের হার গত ছয় বছরে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। তবে দারিদ্র্য কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাসিক গড় পারিবারিক আয় ২০২২ সালে বেড়ে ৩২ হাজার ৪২২ টাকায় পৌঁছায়। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপের তুলনায় এটি প্রায় ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০১৬ সালে মাসিক গড় আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। আর ২০১০ সালে এ আয় ছিল আরও কম ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। তবে আয়ের এ প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও তা হয়তো সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ দেশে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। যারা আয়ের নিম্নসীমায় আছেন, তাদের সম্পদের পরিমাণ আগের চেয়ে আরও কমে গেছে। দেশে আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্য দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমাজে আয়বৈষম্য নিরূপণের জন্য ব্যবহƒত হয় জিনি সূচক। জিনি সূচকের মান হতে পারে শূন্য থেকে এক। কোনো সমাজের সব সম্পদের মালিক একজনই হলে অন্য কারও হাতে কোনো সম্পদ না থাকলে সে সমাজে হবে চূড়ান্ত বৈষম্য এবং এর জিনি সূচক হবে ‘এক’। বিপরীত দিকে যে সমাজের সব সম্পদ সবার মধ্যে শতভাগ সমভাবে বণ্টন হয়ে থাকে, সে সমাজের জিনি সূচক হবে ‘শূন্য’। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের মূল বিতর্কটি মূলত এর দ্বারা মানুষে মানুষে বৈষম্য বোঝাতে পারে না। ওইসিডি যথার্থই বলেছে, জিডিপি আয়ের পরিমাপ করে, তবে সমতা নয়, এটি সামাজিক সংহতি ও পরিবেশের মতো মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে।
জিডিপি হিসাব করা হয় তিনটি উপাদানের ভিত্তিতে। মানুষের ব্যক্তিগত ভোগব্যয়, সরকারের ভোগব্যয় এবং স্থায়ী মূলধন নির্মাণ অর্থাৎ বিনিয়োগ। দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এই অর্থবর্ষে জিডিপি’তে সরকারি ভোগব্যয়ের অনুপাতও বেড়েছে, স্থায়ী মূলধন নির্মাণের অনুপাতও বেড়েছে, কমে গেছে ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের অনুপাত। মানুষের খরচের মাত্রা এখনও কোভিড-পূর্ব স্তরে পৌঁছায়নি।
জিডিপি বাড়ছে, অথচ মানুষের ভোগব্যয় সেই অনুপাতে বাড়ছে না কেন? তাহলে যারা বেশি খরচ করেন, তাদের বদলে রোজগার গেছে যারা বেশি সঞ্চয় করেন তাদের হাতে? বিষয়টা তাহলে কি এমন লোকের হাতে টাকা বেড়েছে, অন্যদের তুলনায় যাদের রোজগারের অনুপাতে ভোগব্যয় কম। তাহলে এমন লোক কারা? গরিব মানুষের রোজগার কম, তাই তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যায় চাল, ডাল, জামা, কাপড়, ওষুধ, যাতায়াত ও লেখাপড়ায়। অর্থব্যবস্থা যদিওবা ঘুরে দাঁড়ায়, তবুও এর সুফল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের বদলে পৌঁছাচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে।
বাংলাদেশে গরিবদের আয়বৃদ্ধির হারের তুলনায় ধনীরা অনেক বেশি হারে আরও ধনী হয়েছেন। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, মোট আয়ে দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষের অংশ ছিল ২১ শতাংশ আর সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল ২৭ শতাংশ। আর ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল কেবল এক শতাংশ লোকের হাতে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেকের হাতে ছিল ১৭ শতাংশ। কিন্তু বেশ কয়েকটি কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা রয়েছে। যেমন দীর্ঘদিন ধরেই বাজেটের বড় ভাগ চলে ভর্তুকি আর পুরোনো ঋণ মেটাতে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খাতায় ক্রমবর্ধমান অনাদায়ী ঋণের পাহাড়। জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বাড়েনি, বাড়ছে সরকারের ঋণ। জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণ ও রাজস্ব আয়ের এ অসামঞ্জস্য দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি মূল্যে জিডিপির মোট দেশজ উৎপাদনের আকার দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে কর আদায় হয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী অধিকাংশ দেশের কর-জিডিপির হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যেমন নেপালের কর-জিডিপির হার হচ্ছে ২৩ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতিযোগী ১০ দেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার পেছনে। অন্য দেশগুলো হচ্ছে শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ভারত, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। উল্লেখিত দেশগুলোতে এই হার ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশ।
কর-জিডিপির অনুপাত দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন দেশে কর আহরণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপ করা হয়। কোনো দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বেশি হলে সম্পদ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বেশি বলে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত বেশ কয়েক বছর থেকে ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনেক অর্জন থাকলেও কর-জিডিপির অনুপাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আশাব্যঞ্জক নয়। তাহলে এর কারণ কী? এর প্রধান কারণ হলো দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় ব্যাপক হারে অব্যাহতি দেওয়া।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে পুরোপুরি ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া আছে। তৈরি পোশাক ছাড়াও বিদেশি পণ্যে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক পণ্যে দেয়া হয়েছে ভ্যাটছাড়। এ ছাড়া ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় রয়েছে ওষুধের কাঁচামালসহ বিভিন্ন প্রসাধনী পণ্য। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্থানীয় পর্যায়ে আহরিত ভ্যাটের পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। সরকারের প্রতি ১০০ টাকার রাজস্ব আদায়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের খরচ সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের খরচ হয় ২১ পয়সা। এ খরচ ভারতে ৬০ পয়সা, থাইল্যান্ডে ৭১ পয়সা, সিঙ্গাপুরে ৭৯ পয়সা, মালয়েশিয়ায় এক টাকা, জার্মানিতে এক টাকা ৫০ পয়সা এবং জাপানে এক টাকা ৭০ পয়সা। তবে এটা ঠিক রাজস্ব খাতে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কমাতে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। ইআরএফ তথ্য মোতাবেক, যদি সব করযোগ্য ব্যক্তি আয়কর সøাব অনুযায়ী কর প্রদান করে, তাহলে জিডিপির অনুপাতে বর্তমানে এক শতাংশ ব্যক্তির আয়কর বাড়িয়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে। এজন্য নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে পরোক্ষ কর ৬৫ শতাংশ এবং প্রত্যক্ষ কর ৩৫ শতাংশ।
আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উন্নত দেশে যেতে হলে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ২১ শতাংশ করতে হবে। আর এর উল্লেখযোগ্য অংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসতে হবে। আবার করপোরেট কর জিডিপির অনুপাতে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে দুই লাখ ৭০ হাজার নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ বা ৩০ হাজারের মতো কোম্পানি কর দেয়। এ ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। যাদের কর দেয়ার ক্ষমতা আছে তারা কম কর দেন। সরকার অনেক খাত থেকে কর পাচ্ছে না। অপ্রচলিত খাতে প্রায় ৮০ ভাগ জনশক্তি কাজ করে। আর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা করের আওতার বাইরে আছে। এসব খাত থেকে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে পারলে বৈষম্য দূর হবে। আবার আবাসন খাত এবং ফেসবুক, আমাজন ও ফুডপান্ডার মতো নতুন ব্যবসার প্রসার হচ্ছে। সেখান থেকে সরকার কাক্সিক্ষত কর পায় না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মোতাবেক, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব বিভাগ মোট তিন লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। বাংলাদেশে কর আদায়ে তুলনামূলকভাবে খরচ কম হলেও কর দিতে গিয়ে করদাতাদের অনেক সময়ই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ আছে। তাই করদাতারা যেন সহজে ও নির্বিঘ্নে কর দিতে পারে, সেদিকে এনবিআরের নজর দিতে হবে। বেশি সম্পদের মালিকদের বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর হিসেবে সারচার্জ আরও বাড়াতে হবে। গাড়ির মালিকদের ওপর বেশি পরিমাণে কর বহাল রাখতে হবে।
সব পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি না দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যে শুধু ভ্যাট অব্যাহতি রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি উপকরণ পুরোপুরি ভ্যাটমুক্ত রাখতে হবে এবং শুধু কৃষি খাতে ভর্তুকি রাখা সমীচীন হবে। তাই করনীতি সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতি বিশ্লেষক