রহমত রহমান: পণ্যের ব্রান্ড হলো কোয়ালিটি আইসক্রিম ও ইয়েস মিনারেল ওয়াটার। পাঁচ বছরে প্রায় ৬৬৯ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি বা সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু দাখিলপত্রে (ভ্যাট রিটার্ন) বিক্রি দেখানো হয়েছে প্রায় ১৫১ কোটি টাকা। বিক্রি গোপন করা হয়েছে প্রায় ৫১৮ কোটি টাকা। যার ওপর প্রযোজ্য রাজস্ব (মূসক ও সম্পূরক শুল্ক) পরিশোধ করা হয়নি বা ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। সানোয়ারা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সানোয়ারা ড্রিংকস অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এই বিপুল পরিমাণ বিক্রির তথ্য গোপন করে রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট। ফাঁকি দেয়া এই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায়ে পৃথক দুইটি মামলা (মূসক আইন, ১৯৯১ ও মূসক আইন, ২০১২) করা হয়েছে। এছাড়া ফাঁকি এই রাজস্ব আদায়ে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। সম্প্রতি এই নোটিশ জারি করা হয়েছে। দেশের আইসক্রিমের বাজারে দ্বিতীয় শীর্ষ ব্র্যান্ড হিসেবে বাজার দখল করে রয়েছে কোয়ালিটি আইসক্রিম। এরপরও প্রতিষ্ঠানটি বিপুল পরিমাণ বিক্রয় গোপন ও রাজস্ব ফাঁকি দেয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
এনবিআর সূত্র মতে, চট্টগ্রামভিত্তিক সানোয়ারা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটি বিক্রয় তথ্য গোপন করে আসছে বলে তথ্য পায় চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট। বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটে সদর দপ্তরের সমন্বয়ে ভ্যাট কর্মকর্তাদের একটি দল ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রামের চান্দগাঁও এলাকায় সানোয়ারা ড্রিংকস অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজে অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি একটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। অভিযানের সময় ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মূসক সংক্রান্ত দলিলাদি দেখাতে বলেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা দলিলাদি প্রদর্শন করলে ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রাথমিক যাচাই শেষে বিপুল গরমিল দেখতে পান। অধিক যাচাইয়ের জন্য প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়। এছাড়া এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের থেকে একটি লিখিত বিবৃতি নিয়ে আসেন ভ্যাট কর্মকর্তারা।
সূত্র আরও জানায়, প্রতিষ্ঠান থেকে জব্দ করা দলিলাদি ও প্রতিষ্ঠানের মাসিক দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) যাচাই করা হয়। এতে বিপুল পরিমাণ বিক্রয় গোপন করায় পৃথক দুইটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মূসক আইন, ১৯৯১ এবং ২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এ মামলা করা হয়েছে। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এ করা মামলার বিবরণীতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ও বাজারজাত করা আইসক্রিম ও মিনারেল ওয়াটারের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক প্রযোজ্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে পণ্য বিক্রি বা সরবরাহ করেছে ৫৩৯ কোটি ২৫ লাখ ৫৫ হাজার ৪৬৬ টাকা। যার বিপরীতে প্রযোজ্য মূসক ৭০ কোটি ৩৩ লাখ ৭৬ হাজার ৮০০ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ২২ কোটি ৩২ লাখ ৯৪ হাজার ২২৩ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের এই চার বছরের দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) ও জব্দ করা দলিলাদি যাচাই করে দেখা গেছে, চার বছরে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি দেখিয়েছে ১৩৪ কোটি ২৭ লাখ ২৭ হাজার ২১৯ টাকা। যার বিপরীতে মূসক ২০ কোটি ১৪ লাখ ৯ হাজার ৮৩ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ৬ কোটি ২৩ লাখ ৭১ হাজার ২৬৮ টাকা পরিশোধ করেছে। চার বছরে বাকি ৪০৪ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ২৪৭ টাকার বিক্রি বা সরবরাহ মূসক দাখিলপত্রে দেখানো হয়নি। যার ওপর প্রযোজ্য মূসক ৫০ কোটি ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭১৮ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ১৬ কোটি ৯ লাখ ২২ হাজার ৯৫৫ টাকা। সুদ ছাড়া ফাঁকি দেয়া মূসক ও সম্পূরক শুল্কের পরিমাণ হলো ৬৬ কোটি ২৮ লাখ ৯০ হাজার ৬৭৩ টাকা। অর্থাৎ চার বছরে বিপুল পরিমাণ বিক্রি গোপনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি এই মূসক ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।
অন্যদিকে, মূসক আইন, ১৯৯১-এ করা মামলার বিবরণীতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের জব্দ করা করা দলিলাদি ও মূসক দাখিলপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ অর্থবছর পণ্য বিক্রি বা সরবরাহ করেছে ১৩০ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার ৯০০ টাকা। যার বিপরীতে প্রযোজ্য মূসক ১৭ কোটি ৩ লাখ ৪১ হাজার ৯৪৩ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ৫ কোটি ৪০ লাখ ৭৬ হাজার ৮০৭ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ অর্থবছর মূসক দাখিলপত্রে (ভ্যাট রিটার্ন) বিক্রয় বা সরবরাহ দেখিয়েছে ১৭ কোটি ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫৩ টাকা। যার বিপরীতে মূসক ৩ কোটি ৮০ লাখ ৫০ হাজার ৫৪৮ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ২৪ হাজার ২১১ টাকা পরিশোধ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ওই অর্থবছর বাকি ১১৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৬ হাজার ৮৪৭ টাকার পণ্য বিক্রয় ভ্যাট রিটার্নে না দেখিয়ে গোপন করেছে। যার ওপর প্রযোজ্য মূসক ১৩ কোটি ২২ লাখ ৯১ হাজার ৩৯৫ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ৫ কোটি ৪০ লাখ ৫২ হাজার ৬৯৬ টাকা। এই এক বছরে সুদ ছাড়া মূসক ও সম্পূরক শুল্কের পরিমাণ হলো ১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৪৪ হাজার ৯১ টাকা, যা প্রতিষ্ঠান বিক্রয় গোপন করার মাধ্যমে ফাঁকি দিয়েছে।
এনবিআর সূত্রমতে, প্রতিষ্ঠানটি বিপুল পরিমাণ বিক্রয় গোপন ও রাজস্ব ফাঁকি দেয়ায় দাবিনামাসংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। ৮ মে পৃথক দুইটি কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে ৪ জুন লিখিত জবাব ও দলিলাদি নিয়ে ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নিতে বলা হয়েছে। ফাঁকি দেয়া মূসক ও সম্পূরক শুল্ক বিষয়ে উত্থাপিত আপত্তি প্রতিষ্ঠিত হলে জরিমানা ও সুদ আরোপ করা হবে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সানোয়ারা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমানকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে শেয়ার বিজের কথা হয়েছে। রিটার্নে সঠিক বিক্রয় দেখানো হয়েছে কিনা-এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, রিটার্নে দেখাবে না কেন। কোনো গ্যাপ থাকতে পারে। যেদিন ভ্যাটের লোকজন এসেছেন, সেদিন আমি ছিলাম। তবে বিষয়টি তাদের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড ফিন্যান্স) সাইফুল ইসলাম দেখেন বলে জানান এই কর্মকর্তা। পরে সাইফুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না। কোনো তথ্য জানার থাকলে অফিস সময়ে ফোন করবেন। এখন আমি ব্যস্ত আছি।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি করেন। পাঁচ বছরে প্রায় ৫১৮ কোটি টাকার বিক্রয় গোপন করেছেন। কীভাবে সম্ভব হলো? প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত প্রযোজ্য মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আদায় এবং এই প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি রোধে ভ্যাট অফিস কঠোর পদক্ষেপ নেবে। একই ধরনের প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিচ্ছে কিনা, তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে।