ফাহমিদা ইসলাম ফারিয়া: আমাদের জীবন দিনে দিনে জটিল হচ্ছে। অফিস, পরিবার, রান্না ও খাওয়া ছাড়াও আছে হাজার রকমের চিন্তা। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে পৃথিবীর সবকিছু সম্পর্কে সহজে জানা, সেই সঙ্গে চিন্তা-ভাবনা ও চাওয়া-পাওয়ার ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। সবকিছুর সহজলভ্যতার কারণে প্রত্যাশা-প্রাপ্তি নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। সময়ের সঙ্গে এসব মনস্তাত্ত্বিক চাপের কারণে ভেতরে তৈরি হয় অস্থিরতা। এই অস্থিরতাকে নিজের ভেতরে পুষে রাখলে ডিপ্রেশনসহ নানা মানসিক রোগের উৎপত্তি হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির রিপোর্ট অনুসারে, ডিপ্রেশনের কার্যকর সমাধান হলো মেডিটেশন।
২০২০ সালে চীনে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণা হয়। এতে ১০৬ চিকিৎসককে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। একটি গ্রুপকে আট সপ্তাহব্যাপী মেডিটেশন প্রোগ্রামে যুক্ত করা হয়। আরেকটি গ্রুপ তাদের চিরাচরিত রুটিনেই জীবনযাপন করে। দেখা গেছে, ধ্যানী চিকিৎসকরা রোগীদের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠেছেন। রোগীর সঙ্গে কথোপকথনে তারা আগের চেয়ে মনোযোগী।
যুক্তরাষ্ট্রের রচেস্টার স্কুল অব মেডিসিন অ্যান্ড ডেন্টিস্ট্রির প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ, লেখক ও কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাইন্ডফুল প্র্যাকটিস ইন মেডিসিনের শিক্ষক রোনাল্ড এম এপস্টেইন বলেন, চিকিৎসক ও চিকিৎসাপেশায় যারা নিয়োজিত, তাদের মধ্যে যারা মেডিটেশন করেন, তারা রোগীদের সঙ্গে কথা বলায় অধিক মনোযোগী। পেশাগত ত্রুটি শুধরে নিতে আন্তরিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তৎপর। পেশাগত চাপ তাদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না।”
বিশ্বজুড়ে এখন প্রায় ৫০ কোটি মানুষ নিয়মিত ধ্যান বা মেডিটেশন করেন। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক, অর্থাৎ সুস্থ থাকতে মেডিটেশন বা ধ্যানের কার্যকারিতা এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণিত।
পুরো বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও দিন দিন মেডিটেশনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য বিদ্যমান চিকিৎসার পাশাপাশি মেডিটেশন যে প্রয়োজন, সেই পরামর্শ এখন চিকিৎসকরা দিচ্ছেন।
নিজের অস্থিরতাকে সংযম করতে হবে নিজের শান্তির জন্য। কাজের চাপ, ব্যস্ততায় অস্থিরতা কিছু সময়ের জন্য ভুলে থাকা গেলে ও একেবারে নির্মূল হয়ে যায় না। মানসিক অস্থিরতা দূর করার জন্য মেডিটেশন খুব কাজ দেয়। মেডিটেশন করলে বিভিন্ন সুবিধা লাভ করা সম্ভব।
ধ্যান বসে বা শুয়ে যেকোনো অবস্থাতেই করা যায়। যেকোনো সময় খাওয়ার আগে বা পরে, সকালে, বিকালে বা রাতে এবং যতক্ষণ ইচ্ছা করা যায়। ধ্যানের ক্ষেত্রে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম বা বিধিনিষেধ নেই। তাই যখনই সুযোগ পাওয়া যায়, মেডিটেশন বা ধ্যান করে নেয়া যায়। প্রতিদিন পাঁচ মিনিটের ধ্যানও দিতে পারে একটি নিয়ন্ত্রিত সুশৃঙ্খল জীবন আর সেই সঙ্গে অনাবিল প্রশান্তি।
মেডিটেশন শুরুর আগে প্রথমেই এ কথা আসতে পারে যে, কতক্ষণ এই মেডিটেশন করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। জবাব হলো, প্রথম দিকে স্থির করে নিতে হবে কতটা সময় ধরে মেডিটেশন করা উচিত। পাঁচ থেকে ১০ মিনিট বা এক ঘণ্টাও এটি করা যেতে পারে। আর এর জন্য বেছে নিতে হবে শব্দহীন ও নিরিবিলি একটি জায়গা।
মেডিটেশন করার ক্ষেত্রে কোথায় বসে তা করা উচিত, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে দেহের স্বস্তিকে। ধ্যান করতে বসে বা শুয়ে যদি আরাম বোধ না হয় তাহলে ধ্যানে মনোযোগ আসবে না। খেয়াল রাখতে হবে, হাত-পায়ের অবস্থান ও বসার ভঙ্গি যেন আরামদায়ক হয়।
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মুভমেন্ট অনুসরণ করতে হবে। শ্বাস ভেতরে যাওয়া এবং বের হওয়ার প্রক্রিয়ার ওপর নজর দিতে হবে। মেডিটেশেনের সময় মানসিক স্থিতি এমন হবে, যাতে মন অন্য কোনো ভাবনায় বুঁদ না হয়ে পড়ে। শরীর, সাম্প্রতিক অবস্থাÑসবকিছু ছাড়িয়ে যেতে দিতে হবে নিজের মনকে। মনকে স্থির করতে হবে যেকোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দু বা বিষয়ের ওপর।
মেডিটেশন শেষ হলে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়া সমীচীন নয়। ধীরে ধীরে একটি অবস্থা থেকে মনকে সরিয়ে নিতে হবে। তারপর দেহ ও মনকে সজাগ করুন। তারপর ধীরে ধীরে মেডিটেশন ছেড়ে ওঠা উচিত।
> মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে ধ্যান। দেহ ও মনের সুস্থতার জন্য যেমন ধ্যান প্রয়োজনীয়, তেমনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ও কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করতে ধ্যানের জুড়ি নেই।
> জীবন সুন্দর করতে ও সময়কে উপভোগ করতেও সাহায্য করে ধ্যান। ধ্যানের অভ্যাস গড়ে তুললে যেকোনো অবস্থানে সুখী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। দেহ ও মনের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করে ধ্যান।
এ ছাড়া প্যানিক অ্যাটাক, মানসিক ভীতি কম করা ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মেডিটেশন।
