ইসমাইল আলী: পরীক্ষামূলকভাবে আদানির বিদ্যুৎ আসা শুরু হয় গত বছর মার্চে। প্রায় এক মাস পর ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে ভারতের এ কোম্পানিটি। দ্বিতীয় ইউনিট চালুর পর জুলাই হতে এক হাজার ৩৫০ থেকে এক হাজার ৫১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে আদানি। যদিও আদানির বিল নিয়মিত পরিশোধ করছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
পিডিবির তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বরের আংশিক বিল বকেয়া রয়েছে আদানির। এছাড়া অক্টোবর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত পুরো বিলই বকেয়া পড়েছে। এপ্রিলের বিল এখনও জমা দেয়নি আদানি। এতে আদানির বকেয়া দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে ডলারের সাম্প্রতিক দর বৃদ্ধির ফলে এ বিল পরিশোধে দায় আরও বেড়ে যাবে। মূলত অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়মিত ভর্তুকি ছাড় না করায় ও ডলার সংকটে আদানির বকেয়া বেড়েই চলেছে।
বকেয়া বিল বাড়তে থাকায় বিভিন্ন সময়ে পিডিবিকে চিঠি দিয়েছে আদানি পাওয়ার। এতে কাজ না হওয়ায় গতকাল আদানির পরিচালক প্রণব বিনোদ আদানি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন। গতকাল তিনি ঢাকায় এসে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সচিবালয়ে যান। যদিও আধা ঘণ্টার বৈঠকে বিস্তারিত কী আলোচনা হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউই কিছু জানাননি।
বৈঠক শেষ করে বিনোদ আদানি দ্রুত অর্থ মন্ত্রণালয় ত্যাগ করেন। এ সময় বৈঠকে কী আলোচনা হলো জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। আমরা বাংলাদেশে আরও কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে চাই।’ আদানির বকেয়া বিলের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুঃখিত আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ এ কথা বলেই তিনি সচিবালয় থেকে বেরিয়ে যান।
আদানির বকেয়া ও বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বকেয়া পরিশোধের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আলোচনা হলেও বকেয়া নিয়ে আদানির পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই। এছাড়া আদানি গ্রুপের পরিচালক প্রণব বিনোদ আদানি জানান, বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। তাই ভাবনায় রয়েছে নতুন বিনিয়োগের বিষয়টি। এছাড়া পারস্পরিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে অর্থমন্ত্রীকে আদানি গ্রুপের কার্যক্রম দেখার আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণও জানান তিনি।
সূত্র জানায়, গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত আদানি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয় ১৫৯ কোটি ৮০ লাখ ইউনিট। এ বিদ্যুৎ (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বাংলাদেশে বিক্রি করে আদানি বিল আদায় করে দুই হাজার ২৪১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এতে বিদ্যুৎ কেনায় বাংলাদেশি মুদ্রার হিসাবে প্রতি ইউনিটে খরচ হয়েছে ১৪ টাকা দুই পয়সা। আদানির এ বিলের মাঝে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৬৩২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং জ্বালানি ব্যয় ছিল এক হাজার ৪৭০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাকি ১৩৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ছিল পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (ওঅ্যান্ডএম) ব্যয়।
চলতি অর্থবছর জুলাইয়ে ৫০ কোটি ৫১ লাখ ও আগস্টে ৯১ কোটি ৮২ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ আদানি থেকে কেনা হয়েছে। এজন্য বিল পরিশোধ করা হয়েছে যথাক্রমে সাত কোটি ৩৮ লাখ ডলার ও ১০ কোটি ২৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ দুই মাসে আদানিকে পরিশোধ করা হয় প্রায় এক হাজার ৯৪১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে ৮৬ কোটি ১৭ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হলেও সে বিল পুরোটা পরিশোধ করা হয়নি। ওই মাসের জন্য আদানির বিলের পরিমাণ ছিল ১০ কোটি চার লাখ ডলার বা এক হাজার ১০৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে এখনও ২৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বিল বকেয়া রয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরের ৯৩৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, নভেম্বরের ৯৬৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা ও ডিসেম্বরের বকেয়া বিল রয়েছে ৭৮৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আদানির বিল বকেয়া দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির বকেয়া বিল আরও যুক্ত হয়েছে এক হাজার ৪৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ফেব্রুয়ারি শেষে বকেয়া বিল দাঁড়ায় চার হাজার ১৪০ কোটি টাকা। মার্চ শেষে তা পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
সূত্রমতে, গত বছর এপ্রিল থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে আদানির আয় ও মুনাফা অনেক বেড়েছে। কোম্পানিটির ২০২৩-২৪ হিসাববছর (এপ্রিল-মার্চ) আয় বেড়েছে প্রায় ৩৭ শতাংশ ও মুনাফা বেড়েছে ৯৪ শতাংশ। আদানি পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, ভারতের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানি পাওয়ারের আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৯৬০ কোটি রুপি (৬৭ হাজার ২৩ কোটি টাকা)। এর মধ্যে ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে আয় হয়েছে সাত হাজার ৩৭০ কোটি রুপি বা প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এটি মোট আয়ের ১৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
২০২২-২৩ হিসাববছরে আদানি পাওয়ারের আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ২৬৮ কোটি রুপি বা ৪৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী হিসাববছরে আদানি পাওয়ারের আয় বেড়েছে ১৩ হাজার ৬৯২ কোটি রুপি বা ১৮ হাজার আট কোটি টাকা। অর্থাৎ বর্ধিত আয়ের অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে আদানি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ হিসাববছরে আদানি পাওয়ারের মুনাফা আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮২৯ কোটি রুপি বা ২৭ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। এর আগের (২০২২-২৩) হিসাববছরে কোম্পানির মুনাফার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৭২৭ কোটি রুপি।
গত হিসাববছরের প্রথম প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে এক হাজার ৪৬৮ কোটি রুপি, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দুই হাজার ৩৪ কোটি রুপি, তৃতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এক হাজার ৮২৪ কোটি রুপি ও চতুর্থ প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দুই হাজার ১৪৪ কোটি রুপি। অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ সময়ে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। যদিও এ সময় শীতের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা তুলনামূলক কম থাকে।
উল্লেখ্য, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশকে উচ্চহারে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত এক বছরে আদানি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে প্রায় ৩৭ দশমিক ৭৫ কোটি ডলার বা চার হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি।