খেলাপি ঋণ ও সরকারি-বেসরকারি শিল্পকারখানা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর মাস নাগাদ দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ২০২২ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের অবলোপন করা ঋণের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৭৯০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে আদায় হয়েছে ২৫৪ কোটি টাকা, যা পুরো ঋণের ১৪ শতাংশ। তবে এই ঋণ আদায়টাও ‘ঋণ-ঋণ খেলা’র মতো একটি প্রক্রিয়া। অবলোপনকৃত ঋণ প্রদান করে ঋণীরা। তারাই আবার ঋণ নেয় অবলোপন করা ঋণের চেয়ে বেশি। এটাকে প্রকৃত আদায় বলা যায় না। ২০২৩ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সংসদে দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তথ্য প্রকাশ করেন। ওই তথ্য থেকে জানা যায়, সিএলসি পাওয়ারের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৬৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের খেলাপি পরিমাণ এক হাজার ১৪২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, রিমেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমান এক হাজার ৭৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, রাইজিং স্টিল কোম্পানির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯০ কোটি টাকা, মোহাম্মাদ ইলিয়াস ব্রাদার্সের খেলাপির পরিমাণ ৯৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, কম্পোজিট লেদারের ঋণের পরিমাণ ৮৭৩ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট লেদারের ঋণ খেলাপির পরিমাণ ৮৫৫ কোটি ২২ লাখ টাকা, কোয়ান্টাম পাওয়ার লিমিটেড সিস্টেমের ৮১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, সাদ মুসা ফেব্রিক্সের ৭৭৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, বি আর স্পিনিং মিলের ৭২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, এসএ ওয়েল রিফাইনারির ৭০৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, মাইশা প্রপাটি লিমিটেডের ৬৮৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা, রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইলের ৬৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা, সামান্নাজ সুপার অয়েল মিলের ৬৫১ কোটি সাত লাখ টাকা, মানহা প্রিকাস্ট টেকনোলজি লিমিটেডের ৬৪৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা, আশিয়ান এডুকেশান লিমিটেডের ৬৩৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, এসএম স্টিল রি রোলিং মিলের ৬৩০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, এহসান রি রোলিং মিলের ৫৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং সিদ্দিকী ট্রেডার্সের কাছে ৫৪১ কোটি ২০ রাখ টাকা। এছাড়া উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রতিটিতে শতাধিক কোটি টাকা খেলাপির বাইরে করে ঋণ আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে এবং বাংলাদেশের সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। এদের বিরাট অঙ্কের ঋণের খেলাপি একসময় এসে অবলোপনের হিসাবে চলে যায়, যা কখনও আদায় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, যার ফলে রাষ্ট্রের কোষাগার বিপুল পরিমাণে অর্থ হারায়। দৈনিক বাংলাদেশের সময় পত্রিকার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ১০ বছরের সরকারি মালিকানাধীন ২৫টি জুটমিল লোকসান দিয়েছে চার হাজার ১৭২ কোটি টাকা। দেশের জুট মিলের লোকসানের পরিমাণ মোট খেলাপি ঋণের প্রায় মাত্র ২৮ শতাংশ। ১০ বছরের চার হাজার ১৭২ কোটি টাকা লোকসানের দায়ে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিলগুলো বন্ধ করেছে সরকার, কিন্তু এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা দৃশ্যমান নেই। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সরকারি ১৩ প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ দুই হাজার ৯০১ কোটি টাকা। গত দুই অর্থবছর আগে খাদ্য ও চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৬১ কোটি টাকা, বিসিআইসির লোকসান ৭২৭ কোটি টাকা, বিএফআইডিসির লোকসান ২২ কোটি টাকা, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল করপোরেশনের ২১ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসার ২৯৩ কোটি টাকা, বিআরটিসির ৬৯ কোটি টাকাসহ সরকারি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের। বাংলাদেশে চিনি কলগুলোর লোকসান এসে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। এই লোকসানের কারণে সরকার দেশের চিনিকল, পাটকল ও বস্ত্রকল সব বন্ধ করে দেয়। সরকারি কলকারখানা বন্ধ হওয়ার মূল কারণ কেউ বের করেননি, বা এতদ্সংক্রান্ত কোনো স্বচ্ছ রিপোর্টও নেই। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনের কারণ পুঁজিবাদের কারসাজি, আর এই পুঁজিবাদের কারসাজিটাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে দেশের আমলাতন্ত্র। দেশের আমলারা রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রশাসনিক আমলাদের জীবনযাপনটা বিলাসী। তারা দামি গাড়ি-বাড়ি ব্যবহারে ব্যাস্ত। কেন শিল্পগুলো রুগ্ণ ও লোকসানি হয়ে যাচ্ছে, তার কারণও তারা বের করেনি, সমাধান তো দূরের কথা। শিল্পের বিষয়ে এদেশের আমলাদের কোনো নজর ছিল না। এদেশের আমলারা ব্রিটিশ ধাঁচেই গড়ে উঠেছে। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো ধ্বংস হয়েছে সরকারি কর্মীদের লুটপাটের কারণে। শিল্পকারখানায় ব্যবহƒত মেশিনারিজগুলো ৫০ বছরের পুরোনো। এগুলোর কোনো প্রকার পরিবর্তন বা সংস্কারও কেউ করেনি। একসময় এসে অকোজো হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর লোকসানি প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত বস্ত্র, চিনি ও পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারায়। কিন্তু কোনো আমলাকে শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে চাকরি হারাতে হয়নি। পরিচালনায় থাকা ব্যাক্তিদের কারণে শিল্পগুলো বন্ধ হয়। চাকরি গেল এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের। অপরদিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এদেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কাপড়ের কল। কাপড়ের কলগুলোর মাধ্যমেই বিকাশ ঘটছে বর্তমানের পোশাকশিল্পের। এদেশে পোশাকশিল্পের বর্তমান বিকাশ ও পাকিস্তানিদের মালিকানায় এদেশে শিল্প গড়ে ওঠার একটি মিল পাওয়া যায়। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশরা পালায়। ভারতবর্ষ দুভাগে ভাগ হয়। পূর্ববাংলা (বাংলাদেশ) অংশ পড়ে পাকিস্তানে। তার নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের বৈষম্যনীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তানে বাড়ে বেকারত্ব। এখানে শ্রম সস্তা থাকায় পাকিস্তানি শিল্পপতিরা গড়ে তুলে শিল্পকারখানা। ঠিক তেমনি ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ধীরে ধীরে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে বাড়ে বেকারত্ব, আর এই সুযোগ নিয়ে এদেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেশি মুনাফাখোররা স্বল্প বেতনে বেকারদের নিয়োগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করছে।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার একটি সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপকে। হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, একটি গ্রুপকেই ব্যাংকের মূলধনের ৯৪৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণ সুবিধা দিয়েছে। অথচ কোনো একক গ্রাহককে তার মূলধনের ২৫ শতাংশ (ফান্ড ও নন-ফান্ডে) বেশি ঋণ দেয়ার নিয়ম নেই। এ-সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনতা ব্যাংককে চিঠি দিলেও তা প্রতিপাললন করেনি জনতা ব্যাংক। সংবাদ সূত্রে আরও জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বেক্সিমকো গ্রুপের মাত্র দুটি গ্রুপের তথ্য জমা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এরপরও বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংকের কাছে ৪৭৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ঋণ আবেদন জমা দিয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপকে কেন এত বড় ঋণ সুবিধা দেয়া হয়Ñতার উত্তরে শীর্ষ ব্যাক্তিরা বলেন, এই গ্রুপে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ কাজ করছে। এখানে প্রশ্নটা চলে আসেÑদেশের ২৫টি পাটকলে প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ কাজ করত। অথচ মাত্র চার হাজার ১৭২ কোটি টাকার লোকসান দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

’৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই দেশটি স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল দেশের সকল সম্পত্তি (শিল্পকারখানা, ভূমিসহ সবকিছুর) মালিক হবে জনগণ। তাই তিনি সব শিল্প কারখানাকে জাতীয়করণ করেন। এদেশি মুনাখোর লোভী পাকিস্তানি দোসররা নিজেদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য জাতির জনককে হত্যা করে ১৯৭৫ সালে।

রাষ্ট্রযন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর আর্দশটা বাস্তবায়ন করতে না পারলে জাতির অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তি মিলবে না।

উন্নয়নকর্মী, মুক্ত লেখক

কাদিরগঞ্জ, দরিখোরবোনা, রাজশাহী

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০