চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেটে প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ নেই

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

বাজেট বেশি বড় করেনি, এটা ইতিবাচক। আয়ের দিক ছোট করলেও ব্যয়ের দিক আগের মতোই রয়েছে। চ্যালেঞ্জিং সময়ে একটা বাজেট দিয়েছে। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বিশাল চাপ রয়েছে, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বিনিময় হারের ওপর। এই তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেটে প্রত্যক্ষ কোনো পদক্ষেপ দেখিনি। এছাড়া পণ্য উৎপাদন বাড়ানো ও প্রণোদনা দেয়া, বাজার তদারকি করা, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং জ্বালানি খাতেও তেমন কোনো স্ট্রং পদক্ষেপ নিতে দেখলাম না। তাছাড়া ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে এত পরিমাণ টাকা নিয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা কী করবে? ব্যবসা না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না, আবার ট্যাক্সও না। ব্যাংক খাতের দুরবস্থা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়নি। তবে কৃষি ও এনার্জি সেক্টরে ভর্তুকি দেয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জিনিসে শুল্ক কমাবে, এটা ভালো জিনিস। যদিও মূল্যস্ফীতি এটা পর্যাপ্ত নয়। আবার কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দিয়েছে, তা ভুল সিদ্ধান্ত। সার্বিকভাবে বলা যায়, বাজেট বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। বাস্তবায়ন করলেও খুব একটা ইম্প্যাক্ট পড়বে, তা নয়। কারণ বাজেট ব্যবসাবান্ধব হয় না। জনবান্ধবও নয়। বিনিয়োগ নির্মাণে পর্যাপ্ত নয়।

বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে আশার কিছু নেই

আবু আহমেদ

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ

দেশের পুঁজিবাজার ছোট হয়ে আসছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষণায় তা আরও সংকোচিত করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোর কর সুবিধা কমিয়ে আনা হয়েছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজার সম্পর্কে ইতিবাচক বক্তব্য প্রদান করছেন। নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তিকরণের প্রতি জোর দিচ্ছেন। সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয় উল্টো পথে হাঁটছেন; যা প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে, শর্তসাপেক্ষে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির আয় করের হার ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পরিপালন করলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। আর শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হলে কর দিতে হয় ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে। অন্যদিকে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোকে কর দিতে হয় ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে। সে হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে একটি কোম্পানি ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কর ছাড় পায়।

বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার বাড়িয়ে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা এবং শর্ত পরিপালন করলে ২০ শতাংশ হারে করের প্রস্তাব করেছেন। অন্যদিকে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোর ওপর ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন। এ প্রস্তাব অনুমোদিত হলে কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে মাত্র ৫ শতাংশ কর ছাড় পাবে। অর্থাৎ কর ছাড়ের হার ২ দশমিক ৫০ শতাংশ কমে যাবে। কয়েক বছর আগেও তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির মধ্যে কর হারের ব্যবধান ছিল ১০ শতাংশ। অর্থাৎ কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে ১০ শতাংশ কর ছাড় পেত। এটি কমতে কমতে এখন ৫ শতাংশে নেমেছে। পুঁজিবাজারের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি না করে উল্টো প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। এতে মানুষ আজ পুঁজিবাজারবিমুখ হচ্ছে। তাই এক কথায় বলা যায়, পুঁজিবাজারে আর আশার কিছু নেই।

গতানুগতিক বাজেটে ‘সাহস দেখেনি

ড. ফাহমিদা খাতুন

নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটকে গতানুগতিক বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চ্যালেঞ্জিং সময়ে এ বাজেট ‘উদ্ভাবনমূলক ও সাহসী পদক্ষেপ নেই’। জাতীয় সংসদে গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবের পর সন্ধ্যায় সিপিডির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে আসেন এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সরকারের আর্থিক নীতির বরাবরের সমালোচক সিপিডি মনে করে, বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যা ও ক্রান্তিকালীন সংকটের সমাধানে বাজেটে যথাযথ পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনা নেই।

ফাহমিদা বলেন, ‘এত একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ে বাজেটটা দেয়া হলো, আমাদের আশা ছিল এ বাজেট অনেকটা উদ্ভাবনমূলক হবে। এখানে সৃজনশীল কিছু পদক্ষেপ থাকবে এবং কিছু সাহসী পদক্ষেপ থাকবে। কারণ, এ চ্যালেঞ্জিং সময়ে গতানুগতিক বাজেট কোনো ধরনের সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। আগামী বছরের বাজেটটা আমাদের কাছে মনে হয়েছে অতীতের আরেকটি বাজেটের মতোই।’

বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১২ শতাংশ বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সেই সঙ্গে তিনি করের আওতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন, কর ছাড় কমানোর চেষ্টা করেছেন।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের জন্য অনেক জায়গায় প্রচেষ্টা দেখছি। যেমনÑদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের জুসের ওপর করারোপ করা হয়েছে, মোবাইল ফোনের টকটাইম, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, থিম পার্কে এন্ট্রি ফি দেয়া হচ্ছে। প্রকারান্তরে এগুলো ভোক্তাদের ওপরে গিয়ে পড়বে, ভোক্তারাই দেবে। এমনিতেই মানুষের ওপরে মূল্যস্ফীতির চাপ, তারপর এরকম বাড়তি কিছু কর থাকে কিংবা পেমেন্ট করার বিষয় থাকে; সেগুলো মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে দেবে।’

লক্ষ্যমাত্রাগুলোয় বাস্তবতার ছোঁয়া নেই

দুই বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই হলেও অর্থমন্ত্রী সেটি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছেন। সিপিডি নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘গত ২৪ মাস ধরে ৯ শতাংশের ওপরে, ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করছে। আমরা এক বছরের মধ্যে সাড়ে ৬ শতাংশে কমিয়ে আনব কীভাবেÑসেটাও একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এ যে লক্ষ্যমাত্রা, এতে বাস্তবতার ছোঁয়া নেই বলে আমাদের মনে হয়েছে।’

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অনৈতিক

বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়েই অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।

তিনি বলেন, ‘১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যাবেÑএ নিয়ে প্রশ্নও করা যাবে না। আমরা সিপিডির পক্ষ থেকে প্রতিবারই বলেছি এটা একেবারে নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়, অর্থনৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়। সামাজিক যে ন্যায়বিচার, সেটাও কিন্তু এটা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ ধরনের পদক্ষেপগুলো বিশেষ গোষ্ঠীদের কথা মনে রেখে করা হয়। কিন্তু ফলাফল দেখা যায়নি, কালোটাকা সাদা করার খুব একটা জোয়ার এসেছে দেখা যায়নি; প্রচুর টাকা এসে গেছে সে রকম হয়নি। আমরা মনে করি, আবার বিবেচনা করে এটাকে তুলে দেবেন।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০