নিজস্ব প্রতিবেদক: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংকোচনমূলক নীতি-কৌশল আরও কিছুদিন চালু রাখার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
আগামী ছয় মাসের মধ্যেই তার ফল দেখার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি, এ বছরের শেষের দিকে (মূল্যস্ফীতি) কমতে শুরু করবে। দেখা যাক, চেষ্টা তো করতে হবে এবং আপনারা এটাও লক্ষ্য করেছেন, বাজেটের আকার আমরা অনেক কমিয়ে রেখেছি, যাতে করে কোনো প্রেশার না পড়ে প্রাইসের ওপর।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পরদিন গতকাল শুক্রবার রেওয়াজ অনুযায়ী ঢাকার ওসমানী মিলনায়নে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থমন্ত্রী। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সচিবরাও তার সঙ্গে ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ যেহেতু এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার সেহেতু সংকোচনমূলক নীতি-কৌশল আরও কিছুদিন চলমান থাকবে।’
তবে সংকোচনের নীতির মধ্যে প্রবৃদ্ধির ধারা যাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার কথাও বলেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাত যেন তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় সব সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এর ফলে সংকোচনমূলক নীতি অনুসরণ সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরে ৫.৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আমরা ৬.৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবো।’
তবে লক্ষ্য অর্জনে সফল হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলছেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি এবং আরও কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, তা পর্যলোচনা করছি। আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশে রাখা সম্ভব হয়েছে। উপস্থাপিত বাজেট বক্তৃতায় মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতির আওতায় যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা উল্লেখ করেছি।’
কভিড-১৯ মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখনও আমাদের দেশে ৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তাদের দেশে সুদের হার বাড়াতে থাকলে আমাদের দেশে ক্যাপিটাল ফ্লো কমে যেতে থাকে। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।’
‘এর ফলে আমাদের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়তে থাকে এবং এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার উল্লেখযোগ্য ডেপ্রিসিয়েশন ঘটে। আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার এটা একটা প্রধান কারণ।’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দুই বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা ক্ষমতায় আসার পর মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে থাকলেও আমরা কিন্তু তা দুই বছরের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে এনেছিলাম। এবারও আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি; তার ফলে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, এটা আমি আপনাদের দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ওএমএস এবং ফ্যামিলি কার্ডসহ যেসব কার্যক্রম চলছে তা চলমান থাকবে এবং প্রয়োজনে এগুলোর পরিসর আরও বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে।’
বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতার সমালোচনা অনেকে করলেও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলছেন, এ নিয়ে চিন্তার কারণ নোই। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেয়া, এটা তো একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রসেডিওর। এটা সব বাজেটে সব অর্থমন্ত্রীরাই করেন, সরকারই করেন এবং উন্নত দেশে এর পরিমাণ অনেক বেশি। আমরা তো এবার ৫ শতাংশের মধ্যে এটাকে ধরে রেখেছি। কাজেই এটা এত কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। তো এটা নিয়ে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নাই।’
চড়া মূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে এনে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৩ শতাংশ পয়েন্ট কমানোর যে লক্ষ্য অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় রেখেছেন, তার পক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ‘বাজেটে নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া হয়েছে। ধান, চাল, গম, ছোলা, মসুর ডালসহ অন্যান্য কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে বিদ্যমান ২ শতাংশ কর কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাজার মনিটরিং করি। বাজার মনিটরিং একটা চলমান প্রক্রিয়া। বাজেটের পর বাজার অস্থির হয়ে গেছে এমন কোনো তথ্য নেই।’
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছেন, কোনো ব্যাংক বন্ধ করে সংস্কার করা হবে না। প্রত্যেকটা ব্যাংক চালু রেখেই ব্যাংকগুলো সংস্কার করা হবে।
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে মানুষ টাকা জমা রাখছে। ব্যাংক সে জন্য সুদ দেয়। ব্যাংক যদি সেই টাকাটা কোথাও বিনিয়োগ করতে না পারে, তাহলে ব্যাংক তো বন্ধ হবে। ব্যাংক বন্ধ করা কোনো সরকারের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যাংকের পারফরম্যান্স ও নন পারফরম্যান্স লোনের অঙ্কটা একদিনের নয় এবং এগুলো বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখা এবং ব্যাংকের সুস্থ পরিচালনা করা; এই দুটোর ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। সরকার এ বিষয়ে সচেতন।’