নিজস্ব প্রতিবেদক: সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এই চ্যালেঞ্জ সরকার ও নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। সেজন্য গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রদত্ত নির্বাচনী ইশতেহারেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে প্রথম অগ্রাধিকারে রেখেছিল আওয়ামী লীগ। তাই প্রত্যাশা ছিল বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুস্পষ্ট পদক্ষেপের নির্দেশনা দেবেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জের স্বীকৃতি থাকলেও সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে, তা উল্লেখ নেই। আর বাজেটে কোনো প্রশ্ন ব্যতিরেকে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, সেটির মাধ্যমে সৎ করদাতাদের তিরস্কার করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ঘোষিত বাজেটের ওপর পর্যালোচনা প্রতিবেদন উত্থাপনকালে এমন মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষকরা। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। এ সময় সংগঠনটির অন্য গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
বাজেটে আবারও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার সমালোচনা করে সিপিডি বলেছে, আয়করের সর্বোচ্চ হার যেখানে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হলো, সেখানে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আবার তাদের কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। এটা নৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা নিয়মিত কর দেন, এর মধ্য দিয়ে তাদের তিরস্কৃত করা হচ্ছে।
পর্যালোচনায় ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেট কোনো সময় দেয়া হচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সেই সঙ্গে রিজার্ভ ক্ষয় হচ্ছে। অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই অস্বস্তিকর অবস্থায় আছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এসব সংকট সমাধানে বাজেটে বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের অর্থনীতির এত সমস্যার মধ্যে তিনটি বিষয়ে এই বাজেটে গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল। তার মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ধরনের কর সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়া। সেখানে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, কিন্তু এটা পর্যাপ্ত নয়।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে মুদ্রানীতি নেয়া হয়েছে, সেটার মাধ্যমে এককভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করা যাবে না। এর সঙ্গে সহযোগী রাজস্ব পদক্ষেপ যদি না নেয়া হয়, তাহলে তা কমানো সহজ হবে না।
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাকাক্সক্ষী বলে মন্তব্য করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে কিছু লক্ষ্যমাত্রা দেয়া আছে, কিন্তু কীভাবে সেটা করা হবে, তার বিস্তারিত কিছু বলা নেই। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বরং আমরা দেখেছি সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের ক্ষেত্রে উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্যমাত্রা দেয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি নিয়ে মোস্তাফিজ রহমান বলেন, এই বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি একটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জনসাধারণ যেসব পণ্য কেনেন, তার অনেকগুলোর ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। অনেক নতুন পণ্যে ভ্যাট আরোপ হয়েছে উৎপাদন পর্যায়ে, যেটা মানুষের ওপর গিয়ে পড়বে। যে সেবা সাধারণ মানুষ নেন, তার ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। যেটা ঘোষিত হয়েছে বছরে চারবার করে বাড়বে। এর সব যদি যুক্ত হয়, এগুলো খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির অংশ। সুতরাং সেদিক থেকে আমাদের কাছে মনে হয়, নতুন যে টার্গেট করছে সরকার মূল্যস্ফীতি আট শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশ করবে। এটা কমানো তো দূরে থাক, বরং মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে।
মোস্তাফিজ রহমান বলেন, খাদ্যের মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যে শুল্ক ছাড় দেয়া হয়েছে, সেটা প্রকারান্তরে আমদানি পর্যায়ে আমদানিকারকদের পকেটে যাবে। এটি সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায় না। শুল্ক ছাড় দিয়ে তেল, আটা ও চালের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। এর ফলে খুব বেশি সুফল আসবে বলে মনে হয় না খাদ্য মূল্যস্ফীতির জায়গা থেকে।
কালোটাকা সাদা করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৫ শতাংশ করের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করাটা অসৎকে উৎসাহিত ও সৎ করদাতাকে তিরস্কার করা হচ্ছে। এগুলো একধরনের প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা। সরকারের কাছে এ মুহূর্তে এমন কোনো ব্যবস্থা চালু নেই, যেটা দিয়ে কালোটাকা ধরতে পারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। সুতরাং সে ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু না হলে এভাবে উদ্বুদ্ধ করা, প্রেরণা দেয়া, কম করারোপ করা, এগুলো দিয়ে কোনো লাভ হয় না।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি নেয়া হবে। কিন্তু বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সেই নীতি থেকে সরে এলো দলটি। এটি আওয়ামী লীগের দর্শনেরও বিরোধী। দুষ্টচক্রের মাথায় হাত বুলিয়ে টাকা অর্থনীতিতে আনা হবে, এটা খুবই দুঃখজনক। এর মাধ্যমে যারা সততার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে বা সৎভাবে চলছে, তাদের কী ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে?’
গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অর্থনীতিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকে আরও ব্যয় সংকোচন করতে হবে, তা না হলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সময় আরও পিছিয়ে যাবে। এবারের বাজেটের মাধ্যমে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। বিভিন্ন সেবার খরচ ও জ্বালানি মূল্য বাড়বে। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হলেও দেশে কালোটাকা ধরার পদ্ধতি নেই।’
আসন্ন অর্থবছরের বাজেট ‘নতুন সরকারের পুরোনো বাজেট’ মন্তব্য করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নতুন অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর কাছে বাজেট নিয়ে যে রকম মুনশিয়ানা দেখতে চেয়েছিলাম, তারা সেটা দেখাতে পারেননি, যে কারণে এটা একদিক থেকে জনগণের জন্য দুর্ভাগ্যের কারণ। এই সময়কালে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার বিষয়। এটি দেখার ক্ষেত্রে যেভাবে আর্থিক সংকোচন দরকার, সেটা যতটা না সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো হচ্ছে, ততটা সরকারি ব্যয়ে দেখছি না। সেখানে আমাদের প্রশ্ন হচ্ছেÑসরকারের ব্যয় সংকোচনটা কবে হবে?