নিজস্ব প্রতিবেদক: আর্থিক খাত অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল খাত। অথচ এ খাত সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। প্রশাসনের সর্বস্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। অবাধে কালোটাকার সঞ্চালন ও পুঁজিপাচার হচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়া হচ্ছে না। এই মডেলও চলছে। আবার বিশেষ শ্রেণির কথা চিন্তা করে অর্থনীতিতে সংস্কার ও ব্যাংক খাত নিয়ে বাজেটে তেমন আলোচনা করা হয়নি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে। দেশ ক্রমেই নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঝুঁকছে। কীভাবে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনা যায়, সে উদ্যোগ দরকার। এখন অর্থনীতির চেয়ে অনৈতিকতা নিয়ে আরও বেশি আলোচনার সময় এসেছে।
গতকাল সোমবার নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এবং সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদরা। গতকাল সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশের বাজেটের যে আকার হওয়া উচিত, রাজস্ব সংগ্রহের নিম্নহারের কারণে তা করার সুযোগ নেই। ফলে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে ঘাটতি অবশ্যই বড় হবে, যার ফলে সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ উন্নয়ন ব্যয় করা যাচ্ছে না। এর ওপর আছে ভর্তুকি ও বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জের বিরাট বোঝা। ’
তিনি বলেন, আবার বাজেট ঘাটতির বড় অংশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেটাতে হবে। তাতে নতুন টাকা ছাপানোর আশঙ্কাও রয়েছে, যেটা বিপজ্জনক। আবার বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণ। এতে নতুন ঋণ দেয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বাজেটে বেসরকারি খাতের যে বিনিয়োগ প্রাক্কলন করা হয়েছে তা অবাস্তব।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এমন পরিস্থিতিতে ন্যূনতম বাজেট দিতে গেলে সেখানে জোড়াতালি, অসংগতি ও অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা থাকবেই। কারণ অর্থনীতি যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তাতে শুধু বাজেট কেন, যেকোনো পরিকল্পনা নিতে গেলেই তা সুখকর হবে না।
ব্যাংক খাত অরক্ষিত বলে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশের ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণহীন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ের পরিবর্তে অপচয় হচ্ছে বেশি। অর্থনীতিতে আস্থার পরিবেশ হারাচ্ছে। অর্থনীতিতে অবৈধ অর্থ যাতে তৈরি না হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেটিও ঠিকমতো কাজ করছে না। এতে অবাধে কালোটাকার সঞ্চরণ হচ্ছে। পুঁজিপাচার হচ্ছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা জমা ও ওঠানো হচ্ছে। খবর প্রকাশিত হলো সাবেক আইজিপি ব্যাংকে প্রচুর টাকা জমা ও উত্তোলন করেছেন। কিন্তু ব্যাংকগুলোর ১০ লাখ টাকার বেশি জমা উত্তোলন রিপোর্ট করার কথা। তাহলে এই টাকার পদচিহ্ন কোথায়?
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, এখন অর্থনীতির চেয়ে অনৈতিকতা নিয়ে আরও বেশি আলোচনার সময় এসেছে। দেশ ক্রমেই নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঝুঁকছে। কীভাবে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনা যায়, সে উদ্যোগ দরকার। নাগরিকদের যেকোনো সেবা নিতে গেলে ঘুষ দিতে হয়। দেশের আইনে ঘুষ নেয়া অপরাধ হলেও ঘুষ দেয়া অপরাধ নয়। ভারতে কিন্তু ঘুষ দেয়াও অপরাধ। বাংলাদেশের এখন এসব বিষয় ভাবার সময় এসেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, এবারের বাজেট প্রণয়নে অলিগার্ক বা লুটেরা গোষ্ঠীর কথা শুনেছেন অর্থমন্ত্রী, যারা ক্ষমতার প্রশ্রয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই শ্রেণিগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। আবার এই বিশেষ শ্রেণির কথা চিন্তা করে অর্থনীতিতে সংস্কার ও ব্যাংক খাত নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয়নি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথাও শুনেছেন অর্থমন্ত্রী। আইএমএফ বলেছে, এবার বেশি উচ্চাকাক্সক্ষী বাজেট করা যাবে না, কারণ সম্পদের সীমাবদ্ধতা। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতিও থাকতে হবে। অন্যদিকে বাজেট গতানুগতিক দেখে মনে হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী আমলাদের কথা শুনেছেন। আমলাদের সুযোগ-সুবিধার যেন কমতি না হয়।
তবে কার কথা শোনেননি অর্থমন্ত্রীÑএমন ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। এই দুই শ্রেণি হলো পরিশ্রমী উদ্যোক্তা ও পরিশ্রমী কর্মী।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সুদহারের নয়ছয়ের (ঋণের সুদ ৯ শতাংশ ও আমানতের সুদ ৬ শতাংশ) বেড়াজাল নীতি দিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করেছি। সমস্যা এক দিনে তৈরি হয়নি, তাই সমাধানও এক দিনে হবে না।’
আহসান মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো মুদ্রানীতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়। মূল্যস্ফীতি কমানো বাজেটের বিষয় নয়, যদিও বাজেট সেখানে সহযোগী ভূমিকা পালন করতে পারে। গত বছরের তুলনায় এ বাজেট সংকোচনমুখী হয়েছে; এখন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কার্যকর হলে মূল্যস্ফীতি কমবে।
সম্প্রতি সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে এবং এটাই যদি দেড়-দুই বছর আগে করা হতো, তাহলে মূল্যস্ফীতির চাপ এখন কম থাকত বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, সুদের হার দেরিতে বাজারভিত্তিক করার কারণে মূল্যস্ফীতির চাপও কমবে দেরিতে।
প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু অসংগতি আছে বলে মনে করেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। ব্যাংক খাত এত দুর্বল যে আমানতের প্রবৃদ্ধি ভালো নয়। আমানতের প্রবৃদ্ধির মোট পরিমাণ এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না। সেখান থেকে সরকারই যদি এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়, তাহলে আর কী থাকবে।
বিদ্যুৎ খাতকে সরকার যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছে বলে মনে করেন আহসান মনসুর। তার মতে, ‘বিদ্যমান ক্যাপাসিটি চার্জ ও ভর্তুকি বজায় রেখে বেশি দূর এগোনো যাবে না। ভারতের আদানি গ্রুপ হোক বা দেশের সামিট গ্রুপই হোক, আমি মনে করি, এদের সঙ্গে আবার দর-কষাকষি (রিনেগোশিয়েট) করতে হবে। এভাবে ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব।’
ব্যাংক খাত নিয়ে গুরুত্বসহ ভাবার পরামর্শ দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, ব্যাংক খাত থেকে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার টাকা পাচ্ছে না, ব্যবসায়ীরাও পাচ্ছেন না। কেন পাচ্ছে না? এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? আহসান মনসুর বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণের চেষ্টা দেখা গেলেও রাজনৈতিক অর্থনীতির চাপে তা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
আহসান মনসুর বলেন, একটি খাতের ব্যর্থতার জন্য সরকারের ঋণের বোঝা এ পর্যায়ে এসেছে। সেটা হলো, রাজস্ব খাত। কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এই রাজস্ব ব্যবস্থা দিয়ে উন্নত হওয়া তো দূরের কথা, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ায় সম্ভব নয়। রাজস্ব আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব। কিন্তু বাজেটে আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারের কথা শোনা যায়নি। শুধু মন্ত্রণালয়ে গুটি গুটি করলে হবে না; সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। তার প্রশ্ন, ‘জনগণ কেন কর দেবে, যেখানে প্রায় সব সেবা পেতে উপরি দিতে হয়?’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘খেলাপি ঋণ মডেলই এখন দেশের জন্য একটা বিজনেস মডেল হয়ে গেছে। আপনি ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন, আর ফেরত দেবেন না। এই মডেল চলছে।’
তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জিং সময়ে বাজেটটা দেয়া হয়েছে। অথচ এতে কোনো নতুনত্ব দেখছি না। আগের বাজেটের অঙ্ক শুধু এদিক-সেদিক করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, সংকোচনমূলক বাজেট, অথচ বাজেটের ঘাটতি তো সংকোচনমূলক মনে না। আবার ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। সরকার যদি বেশি ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত কীভাবে ঋণ পাবে? আর ব্যক্তিগত খাত ঋণ না পেলে কর্মসংস্থান হবে কীভাবে? এ অবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত।
সাবেক এ গভর্নর বলেন, এডিপির আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এ মুহূর্তে যা এক থেকে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। নতুন করে এক হাজার ২৮৫টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এটা অর্ধেক করে দিলেই সরকারের ঋণনির্ভরতা ও ঘাটতি কমবে। বাজেটের নীতিকৌশল ও দর্শনে বলিষ্ট কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না, যা এ সময়ের জন্য দরকার ছিল। এমনিতেই ব্যাংকের মর-মর অবস্থা। সুশাসনের চরম ঘাটতি।
সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী মনে করেন, দেশের অর্থনীতিতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ এবারের বাজেটের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের মতো হবে। অথচ বিষয়ে কোনো ঘোষণা নেই। তিনি আরও বলেন, সংসদে আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট উত্থাপন করা হয়েছে, তার দর্শনকে দর্পণে রূপান্তরিত করার তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদ এমপি। সমাপনী বক্তব্য দেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।