চার মাস বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডলার রিজার্ভ কমছে

রোহান রাজিব: দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদেশি হিসাবে (নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) ডলার রিজার্ভ স্থিতি টানা চার মাস ধরে কমেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর ডলার রিজার্ভ স্থিতি ছিল ৫৮৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার। মে মাসে তা কমে ৫০৪ কোটি ৭২ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ চার মাসে কমেছে ৭৯ কোটি টাকার ডলার। তবে গত আট মাসে ডলার রিজার্ভ কমার পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলোর দায় পরিশোধের তুলনায় ডলার প্রবাহ কম ছিল। তাই টানা কমছে। এছাড়া সোয়াপের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার সরবরাহের কারণেও কিছুটা প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা ডলারের স্থিতি ছিল ৫৮৪ কোটি ৪২ লাখ (৫ দশমিক ৮৪৪ বিলিয়ন) ডলার। ফেব্রুয়ারিতে কমে তা দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি ৪৫ লাখ (৫ দশমিক ৫৩৪ বিলিয়ন) ডলার,  মার্চে ৫৪৩ কোটি ৯৪ লাখ (৫ দশমিক ৪৩৯ বিলিয়ন) ডলার, এপ্রিলে ৫০৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলার এবং সর্বশেষ মে তা আরও কমে ৫০৪ কোটি ৭২ লাখ ডলারের দাঁড়িয়েছে।

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি আরোপের কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরের অক্টোবর থেকে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে পড়ে, যা চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ফেব্রুয়ারিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আমদানি প্রবৃদ্ধি। ওই মাসে আমদানিতে ১৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। তবে মার্চে এসে তা আবারও হোঁচট খায়। ওই মাসে আমদানি প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশের বেশি কমেছে।

এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর প্রথম ৯ মাসে মোট আমদানি হয়েছে ৪৯ দশমিক ২১৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫৮ দশমিক ২৭৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ৯ মাসে আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ০৫৭ বিলিয়ন ডলার বা ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, আগের মাস ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যা ছিল ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। গত ৯ মাসে শুধু চিনি ও জ্বালানি তেল আমদানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাকি সব পণ্যেরই আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ছিল।

দেশে ডলার সরবরাহ প্রধান উৎস হলো রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়। তবে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে দেশের রপ্তানি খাত। গত মে মাসে ৪০৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম। রপ্তানিতে এই পরিমাণ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে আর হয়নি।

মে মাসে রপ্তানি কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে সামগ্রিকভাবে পণ্য রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হারও কমে গেছে। এপ্রিলের শেষে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। মে শেষে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মে মাসে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়েছে। ওই মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট ২২৫ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা প্রায় চার বছরের (৪৬ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ, আর এযাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে দুই হাজার ১৩৭ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের এক হাজার ৯৪১ কোটি ডলারের চেয়ে ১৯৬ কোটি ডলার, যা ১০ শতাংশ বেশি। সেবার পুরো অর্থবছরে এসেছিল দুই হাজার ১৬১ কোটি ডলার। এক মাস বাকি থাকতেই আগের অর্থবছরের প্রায় সমান প্রবাসী আয় এসেছে এবার।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলো এখন বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১১৮ টাকা ৩০ পয়সা পর্যন্ত দরে প্রবাসী আয় কিনছে। এদিকে পণ্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হিসেবে আসা ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্য আমদানির খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে যখন প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি চলছে, তখন আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকায় তা মানুষকে আরও চাপে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ব্যাংকাররা মনে করেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে অর্থ পাচার ও হুন্ডি রোধে বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না করে শুধু ডলারের দাম বাড়ানো হলে তাতে আমদানি ব্যয় বাড়বে, যা সাধারণ মানুষকে আরও চাপে ফেলবে। এ ছাড়া রপ্তানি আয়ও সময়মতো দেশে আনার বিষয়ে উদ্যোগ থাকা দরকার।

আমদানি কমার বিপরীতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও দেশের রিজার্ভ ক্রমেই নিম্নমুখী। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসারে দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ গত ১২ জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে। রিজার্ভ ক্ষয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ঘাটতি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এ ঘাটতি ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল মাত্র ২ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এতে উৎসাহ দিচ্ছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ উৎসাহিত করতে সম্প্রতি দেশের ৩০টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০