মনজুরুল ইসলাম সুমন : স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল। স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অতিনিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষের কল্যাণ অনেকাংশে নির্ভর করে সুস্বাস্থ্যের ওপর। একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সম্পদ হলেও পক্ষান্তরে একজন অসুস্থ মানুষ সবার জন্যই বোঝাস্বরূপ। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ (১) অনুসারে, রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা। তামাক কোনো জনস্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক বা পুষ্টির স্তর-উন্নয়নমূলক দ্রব্য নহে। প্রাণঘাতী এই দ্রব্য জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি পরিবেশের ওপরও জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু অর্জন এবং কিছু সূচকের অগ্রগতি থাকলেও তামাক কোম্পানির প্রলুব্ধকরণ কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কারণে জনস্বাস্থ্য সন্তুষ্টি পর্যায়ে আসেনি।
তামাক এবং বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় ৪ হাজারের বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। যার মধ্যে ৪৩টি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। যদিও বিভিন্ন কারণে মানুষের শরীরে ক্যান্সার হয়ে থাকে। তবে তামাক সেবনের ফলে স্বাস্থ্যের যেসব ক্ষতি হয় তা হলোÑতামাক মূলত হƒৎপিণ্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (ঈঙচউ), (এমফাইসিমা ও ক্রনিক ব্রংকাইটিসসহ), ক্যানসারের (বিশেষত ফুসফুসের ক্যানসার, প্যানক্রিয়াসের ক্যানসার, ল্যারিংস ও মুখগহ্বরের ক্যানসার, মুখগহ্বর ক্যানসার, গলনালি ক্যানসার, পাকস্থলী ক্যানসারের) ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। ৯০-৯৫ শতাংশ ফুসফুস ক্যানসার, ৮০-৯০ শতাংশ মুখগহ্বর ক্যানসারসহ মোট ক্যানসারের ৫০ ভাগের জন্য দায়ী তামাক সেবন ও ধূমপান। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৬১ হাজার নিরপরাধ মানুষকে অযৌক্তিক কারণে হত্যা করেছে তামাক কোম্পানি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়, তামাকের কারণে প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজন লোক মারা যায়। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির ২০১৮ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, তামাকজনিত রোগ, পুঙ্গত্ব ও মৃত্যুজনিত বছরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অপর এক গবেষণা তথ্য মতে, তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর অর্থনৈতিক ক্ষতিপ্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
এখানেই শেষ নয়, তামাক চাষ মাটির উর্বরতা শক্তি কমিয়ে ফেলে। যার কারণে খাদ্যশস্য চাষের জমিও কমে যায়। তামাক চাষে জমির উর্বরতা নষ্ট হলেও কিংবা স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও তামাক কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে দিনের পর দিন তামাকের চাষ বাড়ছে। ফলে রবিশস্যের বদলে তামাক চাষের প্রতি কৃষকরা ঝুঁকছে। বিনামূল্যে বীজ, ঋণে সার ও নগদ অর্থসহ তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তার কারণে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফা লাভের আশায় তামাকের ক্ষেতে কাজ করছেন নারী ও শিশুরা। এমতাবস্থায়ও তামাক কোম্পানিগুলোর কূট-কৌশল ও প্ররোচনার কারণে তামাক চাষ আগ্রাসীভাবে বিভিন্ন খাদ্য ভাণ্ডারের কৃষিজমি দখল করে নিচ্ছে। একসময় কুষ্টিয়া মেহেরপুর অঞ্চলে তামাক চাষ করা হলেও এখন তামাক চাষ সারাদেশে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। গণবসতিপূর্ণ এদেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই সীমিত। তার মধ্যে সড়ক নির্মাণ, শিল্প স্থাপন, ঘরবাড়ি নির্মাণ, নদীভাঙন ও জলবায়ু বিপর্যয়সহ বিভিন্ন কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। দেশে ১৯৭১ সালে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ হেক্টর। বর্তমানে দেশে মোট ৮৮ লাখ ২১ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। শুধু রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় এ বছর ২ হাজার ৮০০ একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তামাক পাতা শুকানোর জন্য চার শতাধিক তামাক চুল্লিতে বনের কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। এসব কাঠ সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সামাজিক বনায়নের বাগান থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতি চুল্লিতে দিনে কমপক্ষে ২০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। সেই হিসাবে চার শতাধিক চুলিতে প্রতিদিন আট হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। প্রতি মৌসুমে এক একর জমিনের তামাক পাতা শুকাতে ৩০০ মণ কাঠ প্রয়োজন হয়।
এক একর জমিতে যে পরিমাণ তামাক উৎপন্ন হয়, তা শুকানোর জন্য প্রায় ৫ টন কাঠের প্রয়োজন হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর ২৯ লাখ ৩২ হাজার গাছ পোড়ানো হয়। এতে করে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ বন উজাড় হচ্ছে। পাশাপাশি তামাক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি, কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রদান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ও জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য অন্যতম দায়ী। এছাড়া তামাক চাষ করতে কৃষিজমি নষ্ট করা হচ্ছে এবং তামাক পাতা শুকাতে বনভূমি উজার করে গাছগুলো কেটেও সাবাড় করা হচ্ছে। তামাক চাষ সারা পৃথিবীর ২.৪ শতাংশ বন উজাড়ের জন্য দায়ী। তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে দেশে সবচেয়ে বেশি বনভূমি উজার হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে। ২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিন আপ বাংলাদেশসহ ১২টি দেশের সাগর থেকে যে বর্জ্য সংগ্রহ করে, তার মধ্যে ১ম স্থানে রয়েছে সিগারেট ফিল্টার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ১৯৭০ সাল থেকে তামাকের কারণে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১.৫ বিলিয়ন হেক্টর বন বিলুপ্ত হয়েছে; যা ২০% বার্ষিক গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির প্রধান কারণ। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে বর্তমানে দেশের সর্বত্র তাপদাহ ও লু হাওয়া বইছে; যা একটি দুর্যোগ সৃষ্টি করছে।
২০০৩ সালের মে মাসে জেনেভায় ৫৬তম সভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে ১৯২টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি কর্তৃক ফ্র্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অব টোব্যাকো কন্টোলবিষয়ক চুক্তি অনুমোদিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গত ১৬ জুন ২০০৩ তারিখে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ওই আন্তর্জাতিক চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার এবং প্রকাশ্য ধূমপানের বিস্তার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহকে সহযোগিতা করা। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্র্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অব টোব্যাকো কন্টোলে প্রথম স্বাক্ষর করে অনেক বেশি প্রশংসিত হয়েছে। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, বিকল্প ফসল চাষ করতে কৃষককে ভর্তুকি ও প্রণোদনা প্রদান করা। কৃষি পণ্যের উৎপাদন ঝুঁকি লাগবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে যুগোপযোগী করা। যেহেতু তখন বাংলাদেশে তামাক মুক্ত করতে কোনো আইন ছিল না। সরকার তামাক চাষ বন্ধে পর্যাক্রমিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তামাক চাষিদের বিকল্প ফসল চাষ করতে উৎসাহিত করবে, প্রয়োজনে চাষিদের অন্য ফসল চাষে ভর্তুকি প্রদান করবে। তামাক প্রক্রিয়াজাত কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। তামাকের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করবে। তামাক কোম্পানিকে সিভিল ও ক্রিমিনাল লায়াবিলিটির আওতায় আনার বিষয়টি ফ্র্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অব টোব্যাকো কন্টোলের ১৯ ধারায় উল্লেখ আছে। তাই তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন যুগোপযোগী করার পাশাপাশি আইন তামাক কোম্পানিকে সিভিল ও ক্রিমিনাল লায়াবিলিটির আওতায় আনা বিষয়টি যুক্ত করা দরকার। ফ্র্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অব টোব্যাকো কন্টোলবিষয়ক চুক্তিকে কার্যকর করতে ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আমাদের প্রতিবেশী বেশ ভুটান ধূমপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
প্রফেসর নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলার রায়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যৌক্তিক সময় বেঁধে দিতে। কারণ উচ্চ আদালতের রায় মেনে চলতে সকলে বাধ্য। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানে অভিভাবক। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য নিশ্চিতকরণের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। তাই মাঠপর্যায়ের উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এই কারণে বঙ্গবন্ধু সুযোগ্যকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, বাংলাদেশকে তামাক মুক্ত করতে।’
কিন্তু অর্বাচীন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কারণে রাষ্ট্রের প্রচলিত বেশি কিছু আইন ও উচ্চ আদালয়ের রায় থাকার পরও তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো তামাক উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার দাবি না করে কেউ সারচার্জ দাবি করছে; আবার কেউ তামাক ব্যবসায়িদের লাইসেন্স দেওয়ার দাবি করছে। তাদের জ্ঞান স্বল্পতার জন্য তারা এই দাবি করছে বলে অনেকেই মনে করেন। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, নিরপরাধ মানুষ হত্যাকারীদের লাইসেন্স কেন? ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তামাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যথাযথ মর্যাদায় এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। কিন্তু অর্বাচীনরা তামাক মুক্তের দাবি না করে তামাকের ওপর সারচার্জ ও ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স দেয়ার দাবি করছে, যেন তাদের ধান্ধা বন্ধ না হয়। তাই বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তামাক চাষ, উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি।
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টি