তারিকুল ইসলাম : একটি দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে একজন নাগরিকের বৈধভাবে জীবিকা অর্জন করার যে অধিকার তা তার নাগরিক অধিকার। আর তার জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। জীবিকা অর্জন করতে গিয়ে সব ধরনের সন্ত্রাসীমূলক, সহিংস, আক্রমণাত্মক, অনিয়ম এবং দুর্নীতি থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার যে অধিকার তা একই সঙ্গে তার নাগরিক অধিকার এবং মানবাধিকার; যা রক্ষার দায় রাষ্ট্র কখনোই এড়াতে পারে না। সুতরাং দেশের নদীপথে বা নৌপথে বৈধভাবে বাল্কহেড দিয়ে বিভিন্ন পণ্য বা মালামাল পরিবহন করে যেসব নাগরিক জীবিকা অর্জন করে তাদের নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পুলিশ, প্রশাসন ও নৌপরিবহন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর এই দায়িত্ব এসে বর্তায়।
এখানে নদীগুলোয় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে ঢাকা ও বিভিন্ন আশপাশের জেলা-উপজেলাগুলোয় বালু সরবরাহকারী বাল্কহেডগুলোর কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও ভৈরব থানা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও আশুগঞ্জ থানা, ঢাকার ডেমরা, চাঁদপুর জেলার মতলবের দশানী ও দেশের বেশ কিছু জায়গার বাল্কহেডগুলোর কথা। যে বাল্কহেডগুলো উত্তরের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলা থেকে বালু, পাথর, কয়লা পরিবহন করে পৌঁছে দেয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। যাদের প্রায় বেশিরভাগই নিবন্ধিত এবং সম্পূর্ণ বৈধ উপায়ে মালামাল পরিবহন করে থাকে।
এই বাল্কহেডগুলো নদীর সাদা বালু বহন করে না। এরা রাস্তা, দালানকোঠা, ব্রিজ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণে যে সিলেকশন বালু বা কনস্ট্রাকশন বালু দরকার হয় তা বহন করে। এ বালুর উৎস দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েক জেলা বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা। বাল্কহেডগুলো সিলেটের জাফলং, গোয়াইনঘাট, সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক থানা, তাহিরপুর থানার ফাজিলপুর, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর ও ডায়া থেকে এ বালু পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যায়। বিশেষ করে যেসব জেলায় এখন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উন্নতমানের রাস্তা, সেতু ও ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। যেমন গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন জায়গায়। এক কথায় চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা বিভাগের প্রায় সকল জেলায় যতটুকু পর্যন্ত যাওয়ার মতো নদী রয়েছে। তাছাড়া রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন জায়গা, কুমিল্লার দাওদকান্দি, নরসিংদীর ঘোড়াশাল, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ইত্যাদি জায়গা তো আছেই। কোনো কোনো সময় উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও অন্য আরও কয়েকটি জেলাতেও যায়। বালুর মতো কনস্ট্রাকশনের কাজে যে পাথর লাগে তাও এরা বহন করে। সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, তাহিরপুর থেকে দেশের নদীগুলোর নিচ থেকে উত্তোলনকৃত পাথর এবং ভারত থেকে আমদানিকৃত পাথর পরিবহন করে নিয়ে আসে। পাথর মূলত ভারত থেকেই আমদানি করা হয়। দেশীয় পাথরের উৎপাদন সামান্য। তাছাড়া তাহিরপুর থানার বর্চরা ও কলাগাঁও থেকে কয়লাও পরিবহন করে এ বাল্কহেডগুলো।
অর্থাৎ এ বাল্কহেডগুলো দেশের নির্মাণ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল ও জ্বালানি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে রাজধানীসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তথা সারাদেশে পৌঁছে দেয়। নৌপথে পণ্য পরিবহনের খরচ কম। বাল্কহেড বাদে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সরু নদী দিয়ে এত ভেতরে পৌঁছে এই মালামাল নিয়ে আসা কঠিন হতো। আনা গেলেও খরচ বাড়ত। আর এই মালামাল নদীপথ ছাড়া সড়ক পথে আনলে পরিবহন খরচ বেড়ে নির্মাণ শিল্পের ব্যয় হতো অনেক বেশি। সরকারের অবকাঠামো উন্নয়নের খরচ বহুলাংশে বেড়ে যেত। সুতরাং বলা যায়, এই বাল্কহেডগুলো সস্তায় নির্মাণ শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহন করছে। যাতে করে দেশীয় নির্মাণ শিল্পের পণ্য ও জ্বালানি হচ্ছে হাতের মুঠোয়। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যসহ দেশীয় ব্যবসার খাত বড় হচ্ছে। ফলে দেশ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে।
অথচ দুর্ভাগ্যবশত বছরের পর বছর এই বাল্কহেডগুলো সারাদেশের নদীপথে চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে তাদের। এক সুনামগঞ্জ জেলাতেই প্রতিটা বাল্কহেডকে অর্ধলাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। সুনামগঞ্জ জেলার সদর, ছাতক, জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর থানায় সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হয়। জেলার তাহিরপুর বাধাঘাট থেকে দৌলতপুরে বিআইডব্লিউটিয়ের নামে পাঁচ জায়গায় পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার টাকা চাঁদা দেয়া লাগে। প্রতিদিন একশো থেকে দেড়শো বাল্কহেড এই চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। এ ব্যপারে অনুসন্ধানী দল ‘তালাশ’ বিআইডব্লিউটিএকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে যুক্তিসঙ্গত ও যথাযথ কোনো উত্তর আসেনি। আর না চাঁদাবাজি কমেছে। সুনামগঞ্জ ছাড়াও সারাদেশেই এরকম কমবেশি চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে বাল্কহেড চালকরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑনদীপথে এত চাঁদাবাজি হচ্ছে কীভাবে? নদীতে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নেই?
বাংলাদেশ নৌপুলিশ নদীপথে সব ধরনের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ব্যাপারে দায়িত্বে আছে। নৌপুলিশই বাল্কহেড চালকদের সব ধরনের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে রক্ষা করার কথা। অথচ নৌপথে তার চিত্র পুরোপুরি উল্টো।
বর্তমানে নদীতে নৌপুলিশ বাল্কহেড চালকদের অন্যতম হয়রানির নাম। নৌপুলিশ বাল্কহেডগুলোয় নৌযান ও চালকদের নিবন্ধনের নথিপত্র ও নিরাপত্তাজনিত আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র আছে কি নাÑতা পরীক্ষা করার জন্য যায়। তারপর সবকিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও নানা কৌশলে বাল্কহেডগুলোয় চাঁদাবাজি করে। চাঁদা না দিলে তারা বাল্কহেডের প্রধান চালকের নামে মামলা করে দেয়। এটাই হচ্ছে নদীতে নৌপুলিশ ও নিরাপত্তার সামগ্রিক চিত্র। বাল্কহেড চালকদের ভাষ্যমতে, চাঁদপুর জেলার চাঁদপুর সদর ও মোহনপুরে নিবন্ধনের নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখার নাম নিয়ে চাপ দিয়ে বাল্কহেডগুলো থেকে আশি থেকে এক লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে। বাল্কহেডগুলো নিবন্ধিত হলেও, নদীতে কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও, নৌপুলিশ কোথায় নদীতে বাল্কহেড চালকদের একমাত্র আস্তাভাজন হওয়ার কথা অথচ তারাই বাল্কহেড চালকদের লুটে খাচ্ছে। সুতরাং একজন নাগরিক হিসেবে বাল্কহেডচালক নদীপথে এভাবে চাঁদাবাজির শিকার হলে তার নাগরিক অধিকার কোথায় রক্ষা পেল। বরং এটা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন যে, নিজ দেশের অভ্যন্তরে এভাবে চাঁদাবাজি ও হয়রানির ভুক্তভোগী। আর রাষ্ট্র যেখানে তার অধিকার রক্ষায় তাকে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা, উল্টো রাষ্ট্রের সুষ্ঠু তদারকির অভাবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকদের হাতেই।
সম্প্রতি দুই ঈদে আগে-পরে ৯-১০ দিন নদীপথে বাল্কহেড চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে নৌপরিবহন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ; যা বাল্কহেড চালকদের জন্য আরেক হয়রানি। সাধারণত ঈদের সময় ঢাকা, চাঁদপুর, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম রুটে লঞ্চ চলাচল অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়। সকল লঞ্চ ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ায় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যাসহ আশপাশের নদীগুলো তখন অনেক ব্যস্ত থাকে। সে অবস্থায় সদরঘাট এবং নদীর সরু জায়গাগুলোয় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে লঞ্চ ও বাল্কহেডগুলোর জন্য। তাই বুড়িগঙ্গাসহ আশপাশের কিছু নদীতে তখন বাল্কহেড চলাচল বন্ধ রাখাই যায়। কিন্তু সারাদেশে বন্ধ রাখা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। যেমন কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঈদে লঞ্চ চলে না বললেই চলে। তো সেখানে কেন বাল্কহেড চলাচল বন্ধ রাখা হবে? বাল্কহেড লঞ্চ চলাচলের রুটে না গিয়ে অন্য জায়গায়ও তো পণ্য পরিবহন করতে পারে। যেমন নরসিংদী, ভৈরব, আশুগঞ্জ রুটে। গত দুই ঈদে বাড়ির পাশে এসেও বাজিতপুরের বাল্কহেডগুলোকে পুলিশ ধরে জরিমানা করে। অথচ বাজিতপুর ভৈরবে ঈদে বাল্কহেড চলাচলের ঝুঁকি বলতে কিছুই থাকে না। আর পুলিশ সেখানে জরিমানার নামে নানা ধরনের হয়রানি করে এবং অন্যায্যা জরিমানা দাবি করে; যা কোনোভাবেই বাল্কহেড চালকদের জন্য সহ্যকর নয়।
বাল্কহেডচালকদের অধিকাংশই স্বল্প শিক্ষিত ও প্রায় মূর্খ। তারা সংগঠিত হয়ে এই সমস্যাগুলোর সঠিক প্রতিবাদ করতে পারে না নানা বাধার কারণে। নাগরিক সমাজও নদীতে কী হচ্ছে সে ব্যাপারে খুব কমই জানে। যার ফলে দেশের নৌপথে বৈধভাবে জীবিকা অর্জনকারীদের সমস্যাগুলো সবার সামনে আসে না। কিন্তু রাষ্ট্রের নৌপরিবহন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। অথচ তাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা মনে নানান প্রশ্ন উঠায়।
দেশের আনাচে-কানাচে নির্মাণ শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মালামাল সস্তায় পরিবহন করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে এই বাল্কহেডগুলোর চালকরা। তাই নিজ দেশের নদীপথে নিরাপদে ও সুবিধাজনকভাবে চলতে পারা তাদের অন্যতম নাগরিক ও মানবাধিকার। আর তাদের এ অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। না রাখলে বাল্কহেড চালকদের দুর্ভোগ শেষ হবে না বছরের পর বছর। রাষ্ট্রের উচিত তাদের এ সমস্যাগুলো সমাধান করে দিয়ে তাদের আরও দক্ষ ও অভিজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলায় মনোযোগ দেয়া। আর অব্যশই দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রশিক্ষণ হতে হবে সহজে অংশগ্রহণমূলক।
শিক্ষার্থী
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়