তিন বছরে লোকসান ২৭২৩ কোটি টাকা

ইসমাইল আলী: বেসরকারি খাতে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০-১১ সালে। এজন্য ফার্নেস অয়েল ও গ্যাসভিত্তিক কয়েকটি ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময় অনুমোদন পায় সামিট মেঘনাঘাট আইপিপি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ফার্নেস অয়েলে চালানোর চুক্তি করা হলেও পরে তা রূপান্তর করা হয় ডিজেলে। এতে তিন বছরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গচ্ছা গেছে দুই হাজার ৭২৩ কোটি টাকা।

সামিট মেঘনাঘাটের ডিজেল অংশের উৎপাদন ক্ষমতা ৩০৫ মেগাওয়াট। কেন্দ্রটিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ৩৩ শতাংশ। এতে উৎপাদিত হয় ১০২ কোটি ৩৯ লাখ ৬২ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। আর উৎপাদন ব্যয় পড়ে দুই হাজার ২০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়ে ১৯ টাকা ৭৩ পয়সা।

ডিজেলের পরিবর্তে ফার্নেস অয়েলে উৎপাদন করা হলে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়ত সর্বোচ্চ ১১ টাকা। এতে ১০২ কোটি ৩৯ লাখ ৬২ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হতো এক হাজার ১২৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে ডিজেলে উৎপাদনের ফলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৮৯৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

একইভাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সামিট মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১০১ কোটি ৪৭ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এতে ব্যয় পড়ে দুই হাজার ৫৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ফার্নেস অয়েলে এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ত এক হাজার ১১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে পিডিবির গচ্ছা গেছে ৯৩৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয় ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ইউনিট। কম্বাইন্ড সাইকেল চালু না হওয়ায় সে বছর গড় ব্যয় ছিল আরও বেশি। এতে গচ্ছা গেছে ৮৯২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ সামিট মেঘনাঘাট থেকে বিদ্যুৎ কিনে তিন বছরে পিডিবির গচ্ছা গেছে দুই হাজার ৭২২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাসুদ শেয়ার বিজকে বলেন, মেঘনাঘাট আইপিপি গ্যাস ও ফার্নেস অয়েলের দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে একই ইঞ্জিনে গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহার সম্ভব নয়। এজন্য বিশেষ ধরনের ফার্নেস অয়েল দরকার, যা বিপিসি সরবরাহ করতে পারেনি। ফলে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে তারা চুক্তি সংশোধন করে কেন্দ্রটি ডিজেলে রূপান্তর করে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। তবে গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় বিকল্প কোনো উপায় ছিল না।

সূত্রমতে, হবিগঞ্জে সামিটের বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করে ২০১৫ সালে। গ্যাসভিত্তিক ৩৪১ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ছিল দুই টাকা ২১ পয়সা। আর বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক আরও দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সামিটের। ১১০ ও ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটিতে গত অর্থবছর উৎপাদন ব্যয় ছিল যথাক্রমে সাত টাকা ৪৩ পয়সা ও আট টাকা ২৩ পয়সা।

একই গ্রুপের সামিট মেঘনাঘাট ৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্বৈত জ্বালানির। তবে গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় ডিজেলে ৩০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে কেন্দ্রটিতে। এতে গত অর্থবছর ইউনিটপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ১৯ টাকা ৭৩ পয়সা। অর্থাৎ প্রায় ৯ গুণ বেশি ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে সামিট মেঘনাঘাট কেন্দ্রটিতে। আর ডিজেলের এ উচ্চ ব্যয়ের চাপ পড়ছে জনগণের কাঁধে। বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম।

এক হিসাবে দেখা গেছে, গ্যাসে উৎপাদন হলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সামিট মেঘনাঘাট কেন্দ্র থেকে সাশ্রয় হতো এক হাজার ২৯৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক হাজার ৩৩২ কোটি ৯৭ লাখ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক হাজার ২৫০ কোটি ছয় লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন বছরে সাশ্রয় হতো তিন হাজার ৮৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, সামিট মেঘনাঘাট কেন্দ্রটিতেও বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা দিয়েছে পিডিবি। এর মধ্যে অন্যতম হলো বছরে ১০ শতাংশ সময় কোম্পানিটি ইচ্ছাকৃতভাবে কেন্দ্রটি বন্ধ রাখতে পারবে সামিট। কোনো ধরনের মেরামতকাজ না থাকলেও এ সুবিধা পাবে। বন্ধ করার আগের দিন একটি ঘোষণা দিলেই চলবে। আবার এ সময় মাসে ৩৭ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া মেরামতের জন্য তিন বছর পর তিন মাস বন্ধ রাখা যাবে কেন্দ্রটি। এ সময়ও ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে সামিট। পাশাপাশি মেরামত ব্যয়ও পরোক্ষভাবে বহন করবে পিডিবি। আর সামিট মেঘনাঘাটের সঙ্গে ২২ বছর জন্য চুক্তিবদ্ধ। অর্থাৎ উচ্চ ব্যয়ের এ বোঝা টানতে হবে লম্বা এ সময়।

পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, ২০১০ সালে বিদ্যুতের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন অনেক কম ছিল। তাই চাইলেও সে সময় খুব বেশি দরকষাকষির সুযোগ ছিল না। তাই দ্রæত বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে এখন অনেক কিছু বিবেচনা করে লাইসেন্স দেওয়া হয়। বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণেও দরকষাকষির সুযোগ অনেক বেশি থাকে।

তিনি আরও বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ মূলত দেওয়া হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহের জন্য। এটি দেওয়া না হলে বেসরকারি খাত কেন বিনিয়োগে আসবে।

যদিও ২২ বছরের জন্য চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সরকার দায়মুক্তি বিধান দিয়ে রেখেছে। ফলে এ খাতে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, জবাবদিহিও নেই। আর এ সুযোগ বেসরকারি খাত বাড়তি সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আইনটির প্রয়োগ বন্ধ না হলে এ খাতে সুশাসনও ফিরবে না।

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০