মিনহাজুর রহমান মাহিম: প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখার জন্য সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক সুন্দর ও সুগঠিত হওয়া উচিত। সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক মূলত গড়ে ওঠে স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সম্মানের ওপর ভিত্তি করে। পড়াশোনার জন্য মানুষ স্কুল-কলেজজীবন শেষে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পদার্পণ করে। স্কুল ও কলেজ জীবনে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক বিশেষ নিয়মের মধ্য দিয়ে পার না করলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিশেষ নিয়মের ভেতর দিয়েই সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করা, সমস্যা সমাধানসহ অন্যান্য কাজ একইসঙ্গে করা, নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, পরস্পরের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা ও সহানুভ‚তিশীল আচরণ করা, বৈষম্য না করা, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় পাশে থাকা, ভয়-ভীতি না পাওয়া প্রভৃতি পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক তৈরি হয় ও দৃঢ় হয়। পরিবারে থাকাকালে যেমন বাবা-মা ছাড়া এবং বাবা-মায়ের দেখাশোনা ও সাহায্য ছাড়া চলা যায় না, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে সিনিয়রদের ছাড়া এবং সিনিয়রদের দিকনির্দেশনা ও সাহায্য ছাড়া চলা যায় না। তবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক নিয়ে রয়েছে নানা অপসংস্কৃতি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রতিনিয়ত জুনিয়রদের সঙ্গে সিনিয়রদের নানা অসৌজন্যমূলক আচরণ, র্যাগিং, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে এবং এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাবি, জাবি, ইবি, জবি, হাবিপ্রবি, যবিপ্রবিসহ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের জন্য বহিষ্কৃত হয়ে থাকে।
র?্যাগিং একটি অপসংস্কৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হওয়ার পর সিনিয়রদের দ্বারা নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হওয়াকে র্যাগিং বলে। ম্যানার শিখানোর নামে শিক্ষার্থীদের জোর করে গান গাইতে বলা, নাচানো, মানসিক প্রেশার দেয়া, জুনিয়র হওয়ায় বৈষম্য করা, নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী চলতে বাধ্য করা প্রভৃতি র্যাগিংয়ের অংশ। এসব অপসংস্কৃতির কারণে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক নষ্ট হয়। মূলত পরবর্তী জুনিয়র না আসা পর্যন্ত এই ধরনের নিয়ম চলমান থাকে এবং ক্রমান্বয়ে এ নিয়ম চলে আসে, যেটিকে ‘চেইন অব কমান্ড’ বলে আখ্যা দেয়া হয়। র্যাগিংয়ের কারণে অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে এবং মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ-সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২৩ অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে র্যাগিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেলে সাময়িক ও স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যারা নিজ পরিবার থেকে দূরে বসবাস করে, তাদের সবার প্রয়োজনে সিনিয়ররা ছাড়া আর কেউই তেমন কাজে আসে না বলা যায়। যেকোনো প্রয়োজনে সিনিয়রদেরই দরকার হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক ভালো থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সিনিয়র-জুনিয়র ভালো সম্পর্ক রাখার জন্য জুনিয়রদের উচিত সিনিয়রদের প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন করা, যেসব সিনিয়ররা সহজে মিশে তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা, সিনিয়রদের কাছ থেকে কিছু শিখার ক্ষেত্রে সংকোচ না রাখা, যেকোনো সমস্যায় সিনিয়রদের জানানো, নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, অসৌজন্যমূলক আচরণ না করা, কোনো সিনিয়র খারাপ ব্যবহার করলে তার সিনিয়রকে অবগত করা এবং তার সঙ্গে বেয়াদবি না করা এবং সিনিয়রদের উচিত জুনিয়র থাকাকালে যে ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তা জুনিয়রদের জানানো, জুনিয়ররা কোনো সমস্যায় পড়লে তা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা, জুনিয়রদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল হওয়া, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে সংকোচ না করা। সর্বোপরি, র্যাগিংমুক্ত, সম্মান ও সহযোগিতামূলক, বৈষম্যহীন সম্পর্কই হতে পারে সিনিয়র ও জুনিয়রদের মধ্যে সবচেয়ে সর্বোত্তম সম্পর্কের উপায়।
একটি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর রাখতে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত সিনিয়র-জুনিয়র মেন্টরিং প্রোগ্রাম তৈরি করা, যেকোনো সমস্যা দ্রæত সমাধান করা, সম্মান ও সহযোগিতার সংস্কৃতি বৃদ্ধির জন্য কর্মশালা ও অনুষ্ঠান আয়োজন করা। একত্রে চলা ব্যতীত বেড়ে ওঠা ও সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই সবারই উচিত বিষয়টি মাথায় রেখে সহানুভ‚তিশীল ও পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে চলা। এতে সুন্দর থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, উপকৃত হবে সব শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থী, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
