কোটা প্রতিযোগিতা যোগ্যতা ও ন্যায্যতা চাকরি প্রাপ্তির শর্ত

দ্বিপাল ভট্টাচার্য্য : ২০১৮ সাল। দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর চাকরি না পাওয়ার ক্ষোভ তুঙ্গে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কাজ নেই, কর্ম নেই, ঘরে ভাত নেই- এসব নানা জঞ্জালকণা একসঙ্গে দানা বেঁধে ছিল! বিস্ফোরণ সৃষ্টি হয়েছিল ছাত্র সমাজের মধ্যে। সারা বাংলার প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আন্দোলন দানা বেঁধে ছিল। মিছিল আর সমাবেশগুলো জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল সেই দিনগুলোতে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরাও আন্দোলনের প্রথম সারিতে থেকে আন্দোলনকে বেগবান করতে সহযোগিতা করছিলেন। বিশেষ করে যারা চাকরিপ্রত্যাশী ছিলেন আর যারা ছাত্র রাজনীতিটাকে পেশা হিসেবে না নিয়ে দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে করতেন তারা আন্দোলনে সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছিলেন। কিন্তু নাটকীয়ভাবে হঠাৎ করে চিত্র পাল্টে যায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াত-শিবিরের আন্দোলন বলে শুরু হয় সক্রিয় ছাত্রকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা। কিন্তু আন্দোলন থামানো যায়নি এক পর্যায়ে একটা সিদ্ধান্তও আসে। যদিও আমরা সেটা মেনে নিইনি। কারণ আমরা কোটা সংস্কার চেয়ে আন্দোলন করছিলাম; বাতিলের জন্য নয়। মজার ব্যাপার হলো কোটা বাতিলের বিষয়কে স্বাগত জানিয়ে যারা মিছিল করেছিলেন তাদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বেড়েছিল পরবর্তী সময়। কারণ একটাই আমরা সংস্কার চেয়েছিলাম বাতিল চাইনি। অন্যদিকে কোটা সংস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ওপর হামলাগুলোতে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় দিলেও ছাত্র-শিক্ষা-চাকরি এসবের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল না। তারা ছাত্ররাজনীতিকে নিজেদের অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা লোক। বখাটে থেকে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে অর্থসম্পদের মালিক হওয়া লোক। তবুও আমার মতো লাখ লাখ সাধারণ ছাত্রের সম্পৃক্ততায় আন্দোলন অব্যাহত ছিল একটা পর্যায়ে একটা সমাধানও হলো। তখন আমি নিজেও অনেক মুক্তিযুদ্ধের কোটাপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলেছি ‘আমরা কোটা বাতিল চাইনি, সংস্কার চেয়েছিলাম,’ কিন্তু প্রথম আর দি¡তীয় শ্রেণির চাকরি থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে তৃতীয় আর চতুর্থ শ্রেণিতে কোটার সুযোগ দেয়া মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রত্যাশীদের অপমানের শামিল। কিন্তু কথা কেউ কানে নেয়নি কিংবা নিলেও কিছুই করার ছিল না।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল একটি গণ-আন্দোলন। কিন্তু যারা নব্য জমিদারি স্টাইল চালু করছেন তারা বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেননি। তাদের চাওয়া চাকরিহীন, অর্থহীন, সুযোগ-সুবিধাহীন শ্রেণি আজীবন এভাবেই থাকবে বঞ্চিত হবে ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে। আর যারা সব সুযোগ পেয়ে বড় হয়েছেন তারা আরও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হবেন। মানে রাজার পোলা রাজা, প্রজার পোলা প্রজাÑএমন ধারা আজীবন ঠিকে থাকবে। 

তবে বিভিন্ন মতাদর্শী রাজনৈতিক কর্মীদের মতো জামায়াত কমী-সমর্থকদেরও অংশগ্রহণ ছিল এটা সত্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে চেতনা ব্যবসায়ী চক্র এই আন্দোলনের গুরুত্ব কমানোর জন্য জামায়াতের সম্পৃক্ততার আন্দোলন বলে প্রোপাগাণ্ডা শুরু করে দিল। যার শিকার হয়েছিলেন সক্রিয় ছাত্র আন্দোলন কর্মীরাও। আমার ওপরেও করা হয়েছিল হামলা, জামায়াতের সম্পৃক্ততা বলে বিষয়টি হয়ে গেল হালকা। দায়িত্বে থাকা বড় বড় কর্তারা সে-সময় এমনটাই বলছিলেন।

কোটা কেন লাগবে?

এক. চাকরিজীবীর সন্তান সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েই বড় হয় তার আবার কেন সবকিছুতে কোটা লাগবে; দুই. কোটা দিয়ে স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়ার পর তার কেন আবার কলেজে কোটার দরকার হবে? কলেজে কোটা দিয়ে ভর্তি হওয়ার পর তার কেন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা লাগবে? কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পর তার কেন আবার চাকরিতে প্রবেশ করার জন্য কোটা লাগবে? এক কোটা আসলে কয়বার ব্যবহার করবেন; তিন. শিক্ষকের সন্তান শিক্ষক হবেন, ডাক্তারের সন্তান ডাক্তার হবেন, চাকরিজীবীর সন্তান চাকরিজীবী হবেন আর কৃষকের সন্তান কৃষক হবেন এই অনৈতিক কর্তৃত্ববাদী আইন প্রতিযোগিতামূলক মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কতকাল চলবে? কোটাধারীর কোটা শুধু কোটা কেন বার বার লাগবে; চার. মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা না দিয়ে সামান্য সুযোগ-সুবিধার লোভ দেখিয়ে দেশকে মুক্তিযোদ্ধাদের মানাতে পারবেন? শত শত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি হয়েছে আবার মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান- নাতি-নাতনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহু দূরে চলে গেছে তাদের জন্য কেন কোটা লাগবে; পাঁচ. আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা দিচ্ছেন, বাসস্থান দিচ্ছেন, চিকিৎসা দিচ্ছেন আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা দিলেও ক্ষতি নেই বরং জাতি হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব! কথা হলো এসব সুযোগ-সুবিধা দিয়েও আবার কেন চাকরিতে প্রবেশের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা দিতেই হবে? এই পার্সেন্টেজ একটু কমালে আর ব্যবহারের বিষয়টা যেকোনো একবার নিশ্চিত করলে সমস্যা কি হবে; ছয়. যাদের পরিবারে একজনও সরকারি চাকরিজীবী নেই তাদের জন্য চাকরির সুযোগ করে দিলে কী সমস্যা হবে?  যাদের মাথায় তেল আছে তাদের মাথায় তেল দেয়ার মতো এই কোটা আর কতকাল ব্যবহার করতে হবে; সাত. এক কোটা বার বার কত ক্ষেত্রে কতভাবে ব্যবহার করতে হবে; আট. কোটা আসলে কার লাগবে  আর  সুযোগ নিচ্ছেন কারা, হিসাবটা কে মেলাবে; নয়. কেনইবা কোটা সংস্কার না করে কোটা বাতিলের প্রশ্ন আসবে?

ব্যাংকার

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০