আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: অর্থনীতির ভাষ্য মতে, অভাব তিন প্রকার, প্রয়োজনীয় অভাব, আরামপ্রদ অভাব, বিলাসজনিত অভাব। আধুনিক অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথের মতে, অর্থনীতি হলো সম্পদের বিজ্ঞান, তবে সম্পত্তির বিজ্ঞান নয়। গণপরিসর, উদ্যান ও পার্ক- এগুলো আমাদের সম্পদ, সম্পত্তি নয় যে ইচ্ছা হলো আর কেটে ফেললাম বা বিক্রয় করে দিলাম। সম্পত্তি বিক্রয় করা গেলেও সম্পদ বিক্রয় করা যায় না। কিন্তু লোভের কোনো প্রকারভেদ আছে বলে জানা নেই। তবে লোভের একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
এক পুকুরে একটি বড় মাছ বাস করত, সেই মাছটি ছিল অতিলোভী ও রাক্ষসে প্রকৃতির বলা চলে। সামনে যে খাবারই পেত, তাই মুখে দিয়ে সাবাড় করত। আশ্চর্যের বিষয়, সে মাছটি যতই খায়, ততই তার ক্ষুধা বাড়ে। এভাবে পুকুরের ছোট-বড় সব মাছ খেয়ে শেষ করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত পুকুরে আর কোনো মাছ ও খাবার মতো খাদ্য থাকল না। একসময় মাছের দেহটিও দৈত্যাকৃতির ধারণ করে। মাছের শরীর এতই বড় হয়ে যায় যে, নিজের শরীর ও লেজ কোথায় তা নির্ণয় করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। পুকুরের সব মাছ ও খাদ্য শেষ হয়ে গেলে ক্ষুধার জ্বালায় ওই লোভী মাছটি কাতরাতে থাকে। ক্ষুধায় কাতরানো সেই মাছ শেষ পর্যন্ত নিজের লেজকে খাবার মনে করে নিজের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। বর্তমানে আমাদের অবস্থা সেই মাছের মতো। তাই নয় কি?
বৃক্ষ আমাদের প্রাচীন বন্ধু। সভ্যতায় বৃক্ষ, অরণ্য, উদ্যান খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের অনেকগুলো পূর্বশর্তের মধ্যে গাছ অন্যতম। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর পরিবেশকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে গাছের ভূমিকা অপরিসীম। মানব দেহের ফুসফুসের মতো পার্ক ও উদ্যান একটি শহরের ফুসফুস হিসেবে কাজ করে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ অন্য উদ্যানগুলো ঢাকার ফুসফুস। এই শহরে যত মানুষ বাস করে সেই তুলনায় এই ফুসফুস অপ্রতুল বটে। এই রকম উদ্যান শহরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমাতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখে। বিনোদন ও শরীর চর্চার কেন্দ্র হিসেবেও পার্ক এবং উদ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আমরা এখনো তা অনুধাবণ করতে পেরেছি কি?
রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাকৃতিক সম্পদ, বন, বনভূমি ও উদ্যান ধ্বংস করার অপকর্ম অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা তার আগেও দেখেছিলাম ব্রাজিল সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে আমাজন বনকে সাবাড় করার ঔদ্ধত্য ও স্পর্ধা দেখিয়েছে। অনেক রাষ্ট্র উদ্যান, বন, বনভূমি, জলাশয় ইত্যাদি ধ্বংস ও সাবাড় করার সময় বিভিন্ন খুঁড়া যুক্তি দিয়ে থাকে। কিছুদিন আগে ওসমানী উদ্যান ধ্বংসের কর্মযজ্ঞে নেমেছিল রাষ্ট্রীয় একটি সংস্থা, কারণ ছিল ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিং করার মতো খোঁড়া যুক্তি। পার্ক বা উদ্যান নষ্ট করে গাড়ি পার্কিং করার জন্য স্থান নির্ধারণ করা কতটা যৌক্তিক। তাই প্রাচীন রোমান লেখক প্লুটার্ক তার লাইভস”বইতে লিখেছেন- ‘গাছের মাথা যখন কাটা হয়, তা আবার তাড়াতাড়ি গজায়; কিন্তু মানুষের মাথা একবার নষ্ট হলে আর সহজে প্রত্যাবর্তন করে না’। যার প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নের অপকর্মে- করোনাকালে মহাআনন্দ নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে অবকাঠামো ও রেস্তোরাঁ নির্মাণের নামে সাবাড় করা হয়েছে শতবর্ষী বৃক্ষরাজি। উদ্যান আমাদের কাছে ফুসফুস আর পুঁজিবাদীদের কাছে তা ব্যবসা। তাই দুর্ভাগ্য এই যে, ফুসফুসকে কেটে ফেলতে রাষ্ট্রীয় সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, নির্মাণ করেছিল অবকাঠামো। এই অকর্ম এবং অকার্য অর্বাচীনতার পরিচয় নয় কি? এই বছর (২০২৪ সালে) এপ্রিল থেকে পড়া প্রচণ্ড দাবদাহ বুঝিয়ে দিয়েছে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা।
অতি সম্প্রতি কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঞ্চলিক মহাসড়কটি প্রশস্তকরণের নামে কেটে ফেলা হয়েছে সড়কের দুই পাশের পুরোনো গাছগুলো। অর্ধশত বছর ধরে ওই আঞ্চলিক মহাসড়কে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাঁচ সহস্রাধিক গাছ। কথিত উন্নয়ন কাজের নামে প্রায়ই বিভিন্ন এলাকার পুরোনো গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও পঞ্চগড়ে সড়কের দুই পাশের ছয় হাজার গাছ কাটার প্রস্তুতি বন বিভাগের। গাছে নাম্বারিং করে দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার চূড়ান্ত করেছে বনবিভাগ। গাছগুলো রেখেও বিকল্প উপায়ে সড়ক প্রশস্ত কাজ করা যেত। বৃক্ষ নিধনের এমন মহোৎসবের কারণে পরিবেশের ওপর বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমান তীব্র তাপপ্রবাহ তারই উদাহরণ।
যদিও গণপরিসর (উদ্যান, পার্ক, মাঠ) রক্ষায় বাংলাদেশ সংবিধানসহ রাষ্ট্রের প্রচলিত অনেক আইন রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ বর্ণিত আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তাবিধান করিবেন। এছাড়াও মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্ম–ক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক সংরক্ষণের জন্য বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে রাষ্ট্র ২০০০ সালে আইন প্রণয়ন করেন।
কোনো একসময় আইন বলতে বুঝাত নৈতিকভাবে বৈধ বা সিদ্ধ বিষয়কে। অর্থাৎ যে কার্য নৈতিকভাবে সিদ্ধ, সেই কাজ বৈধ ছিল। আর যা নৈতিকভাবে সিদ্ধ না, তা ছিল অবৈধ। অবৈধ কার্য করলে শাস্তি দেওয়া হতো। বর্তমানে আর নৈতিকতার বিষয় নেই, বৈধ বা অবৈধ বলা বা ঘোষণার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। সরকার গণপরিসর ও উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইন করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সংবিধানসহ প্রচলিত উপরিউক্ত আইনকে অবজ্ঞা, অবহেলা এবং তুচ্ছ করে কেন এই অনৈতিক আনন্দযজ্ঞে মত্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা, যা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে।
নাটক এবং সিনেমায় দেখা যায়, সিঁধ কেটে চোর গৃহে প্রবেশের আগে লাঠির মাথায় পাতিল দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করানো হতো, মালিক বা পাহারাদার টের পেয়েছে কিনা তা জানতে। যখন জানতে পারে কোনো প্রকার সাড়া-শব্দ নেই, তারপর ঘরে প্রবেশ করে মালামাল নিয়ে পালিয়ে যেত। উদ্যান ও গণপরিসর ধ্বংসের কর্তৃপক্ষের আনন্দযজ্ঞে, সিঁধকাটা চোরের আচরণের সঙ্গে অনেক মিল পাওয়া যাচ্ছে। সম্পদ অনিষ্ট সাধন করার উদ্দেশ্যেই এসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব সম্পদ অনিষ্টসাধন কাজে নৈতিকতার বালাই নেই। আমাদের রাষ্ট্র সেই দিকে যাচ্ছে কিনা, তা প্রতিটা নাগরিকের ভেবে দেখা দরকার। কারণ বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭(ক) বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। মালিক অর্থাৎ জনগণের অনুমতি ছাড়া কেন উদ্যান ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে।
কভিড সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে চলমান লকডাউনে নগরবাসীকে অন্ধকারে রেখে কয়েক মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাঝারি আকৃতির প্রায় অর্ধশত গাছকাটা হয়েছিল এবং পরে বড় বড় গাছও কাটা হয়েছে। জাতির বিবেকের কাছে জনস্বার্থে প্রশ্ন রাখতে চাই; এই করোনা মহামারির সময়ে অনেক কিছুই লকডাউন চললেও, ‘দিনদুপুরে পুকুর চুরি’ অর্থাৎ মালিকের সম্পত্তি আত্মসাতে লকডাউন নেই কেন? ওই ‘লকডাউন দিয়েছিল জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবন বাঁচাতে, নাকি মালিকের সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য’ বড় একটি প্রশ্নবোধক হয়ে রইল। যদি জনস্বাস্থ্য ও জীবন সুরক্ষায় হয়ে থাকে তা হলে সরকার আন্তরিক ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
কিছু দিন পরে হয়তো দেখব, সিঁধকাটা ব্যক্তি এই ঘরের মালামাল ও সম্পদ সরিয়ে এবং গৃহশূন্য করে অন্য আরেকটি গৃহে প্রবেশ করবে। তখনও সম্পদের মালিক (বেশকিছু সচেতন নাগরিক) সম্পদ রক্ষায় প্রতিবাদ জানাবে, কিন্তু সম্পদ রক্ষা করতে পারবে কি না জানি না। তবে পরবর্তী দৃষ্টি, কোন্ ঘরের দিকে তা আমরা এখনো জানি না। তবে পূর্বঅভিজ্ঞতার আলোকে অনুমান করা যায়, পরবর্তী লোলুপ্ত দৃষ্টি হয়তো অন্য কোনো উদ্যান বা পার্কে। জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ ও অনিষ্টকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।