আসাদুল্লাহ গালিভ আল সাদি: সাম্প্রতিক সময়ে দুটি আন্তঃসংযুক্ত ইস্যুর উদ্বেগজনক বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। অনলাইন জুয়ার বিস্তার এবং প্রবাসীদের লক্ষ্য করে প্রতারণামূলক লটারি। এই জোড়া সংকট শুধু অগণিত ব্যক্তির আর্থিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করেনি বরং সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য রাজস্ব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে এনজিও এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, জমি বন্ধক রেখে জুয়া খেলে ও লটারি কেটে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। তরুণদের অনেকেই কৌতূহলবশত এ মারণ খেলা শুরু করার পরেই নেশায় পড়ে যাচ্ছেন। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময় লোভে পড়ে এক পর্যায়ে খোয়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। জুয়ার কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য জীবনে কলহ। খেলার টাকা জোগাড় করতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও ভাড়ায় খুনের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে তারা।
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে মোবাইল ফোন। আঙুলের এক ক্লিকে চোখের সামনে নিমিষেই হাজির হয় হাজারও তথ্য। স্মার্ট ব্যাংকিং, ইউটিলিটি বিল ও জমির খাজনা পরিশোধ, আয়কর রিটার্নসহ হাজারও নাগরিক সুবিধাকে মানুষের হাতের কাছে নিয়ে এসেছে স্মার্টফোন। এর সুফল পাচ্ছেন পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ। তবে মুদ্রার উল্টোপিঠের মতো এই স্মার্টফোনের কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। এত সুবিধা নিয়ে আসা স্মার্টফোনের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে ভার্চুয়াল জুয়ার দৌরাত্ম্য। তার আঁচ লেগেছে দেশের উত্তরের জেলা নীলফামারীতেও।
নীলফামারী জেলায়, বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ উপজেলায়, প্রতারক চক্রের অত্যাধুনিক নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে। এই চক্রগুলো প্রাথমিকভাবে প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করে, থাই লটারি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের প্রলুব্ধ করে। চুরি হওয়া ন্যাশনাল আইডেন্টিফিকেশন (এনআইডি) কার্ড ব্যবহার করে ভুয়া ফেসবুক এবং ইমো আইডি তৈরির মাধ্যমে তাদের কাজ শুরু হয়। একবার এই অ্যাকাউন্টগুলো সেট আপ হয়ে গেলে, প্রতারকরা তাদের লটারির পোস্টগুলো বিভিন্ন প্রবাসী সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে শেয়ার ও কমেন্ট করা শুরু করে। এরপর সোশ্যাল মিডিয়াতে ডলারের মাধ্যমে লটারির ভিডিও বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাপক মানুষের কাছে পৌঁছায় তারা।
প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন অত্যন্ত লোভনীয়ভাবে ডিজাইন করা হয়। এতে মডেল হিসেবে দেখা যায়, জনপ্রিয় মুখ, যার কারণে সাধারণ মানুষ এসব বিজ্ঞাপনকে বিশ্বাস করে। প্রায়ই দ্রুত এবং যথেষ্ট আর্থিক লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় সেসব ভিডিওতে। কিছু ভিডিওতে প্রবাসীদের বিশ্বাস অর্জনের লক্ষ্যে ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে ভিডিও করতেও দেখা গেছে প্রতারকদের। প্রবাসীদের বিভিন্ন যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম যেমন ইমু, হোয়াটসঅ্যাপ এবং এমনকি বিকাশ এবং রকেটের মতো জনপ্রিয় মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবার মাধ্যমে প্রতারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। একবার যোগাযোগ স্থাপন করা হয়ে গেলে ভুক্তভোগীদের লটারির ফি বা ট্যাক্সের কথা বলে বড় অঙ্কের অর্থ পাঠাতে বাধ্য করা হয় ব্রেনওয়াশ করে।
বাংলাদেশের জনসাধারণের কথা বলতে গেলে বেশির ভাগই দরিদ্র এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত? শ্রেণির। তবে? সমাজে সব শ্রেণির মানুষ?ই আছে। যারা? রিচ ফ্যামিলি থেকে বড় হয় কিংবা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে থাকে তারা একটা খুবই বড় ধরনের প্রিভিলেজ পায়। তাদের সাধারণত টাকা-পয়সা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না। খেয়াল করলেই দেখা যায় তাদের একটা বড় অংশ সবার আগে বাইক, দামি মোবাইল, লেটেস্ট ফ্যাশন ইত্যাদি ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
যারা দরিদ্র এবং তুলনামূলক অসচ্ছল পরিবারে বড় হয় তাদের বেশির ভাগ যারা অনলাইন জুয়ায় আসে তাদের মাঝে এই মাইন্ডসেটটুকু থাকে যে খুব কম?ই খেলব কিংবা শুধু নিজের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য খেলব। অনেকের মাঝে টার্গেট থাকে যে একটা দামি মোবাইল কেনার টাকা কিংবা বাইক কিনার টাকা ওঠে গেলেই তারা জুয়া বন্ধ করে দেবে।
জুয়াড়িদের বাজি হারার পর মাথায় আসে একটুর জন্য ম্যাচ হারল। হয়তো এর পরেরবারে জিতে যেতে পারি। এই মানসিকতার জন্য দিনে দিনে তাদের বাজি ধরার টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে। অতপর হঠাৎ একদিন বাজির দল হেরে যায়। সেই সঙ্গে লস পরে যায় তাদের? সব টাকা।
টাকা লস করার পর তাদের বোধোদয় হয় যে জুয়ার পেছনে অনেক টাকা গেছে। এই টাকা লস কভার করতে হবে। ফলে বিগত লস করা টাকা তুলার জন্য তারা আবার জুয়ার টাকা রিচার্জ করে। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। কারও খোয়ানো টাকার পরিমাণ পোছায় ৫ থেকে ৬ হাজার কারওর বা লাখখানেক টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা লস করার জন্য তারা আবার জুয়া ধরে। প্রথম দুই-তিন ম্যাচ জেতার পর তাদের লোভ বৃদ্ধি পায়। বড় ধরনের বাজির টাকা তারা আবার বেট ধরে কিন্তু যদি হেরে যায় তাদের লস কভার করা দূরের কথা আরও বেশি লোকসানে পাল্লা ভারী হয়ে ওঠে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ উপজেলার সলিমের বাজার এলাকা থেকে থাই লটারির নামে প্রতারণার অভিযোগ জনৈক তাজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় সলিমের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামকে আটক করলেও তিনি হাতকড়াসহ পালিয়ে যান। এর আগে কিশোরগঞ্জ উপজেলায় এ চক্রের মোট সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অজ্ঞাত ১১৮ জনের নামে মামলা করে ডিবি পুলিশ। এসব ঘটনা জানান দিচ্ছে অর্থের লোভে শিক্ষকদের মতো সম্মানীয় ব্যক্তিরাও এই প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ছেন।
সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের জয়বাংলা এলাকার ও হাজারিহাট এলাকার কতিপয় প্রতারক তারাগঞ্জ সদর, কুর্শা, আলমপুর, চিকলীসহ পুরো তারাগঞ্জ উপজেলা ও বদরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নসহ সৈয়দপুর শহর ও বিভিন্ন গ্রাম এলাকায় এই চক্রটির সম্প্রতি দৌরাত্ম্য বেড়েছে। অদৃশ্য মদতদাতা থাকায় থাই গেম-জুয়া ও ভিসাচক্রের সদস্যরা সহজ-সরল মানুষজন, যুবক ও প্রবাসীদের টাকায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
হুন্ডির ব্যবহার (একটি অনানুষ্ঠানিক অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থা) সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে, কারণ এটি কেবল জালিয়াতিকে সহজতর করে না বরং সরকারকে যথেষ্ট রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত করে। হুন্ডি লেনদেনের অবৈধ প্রকৃতি অর্থের প্রবাহকে শনাক্ত করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন করে তোলে, যার ফলে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয় দেশ। আর্থিক ক্ষতির বাইরে, ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক ক্ষতি গভীর। অনেক প্রবাসী, কোটিপতি হওয়ার প্রলোভনে এই কেলেঙ্কারির শিকার হওয়ার পরে নিজেদের মারাত্মক সমস্যায় ফেলে। ফলস্বরূপ আর্থিক নিঃস্বতা প্রায়শই গুরুতর চাপ, বিষণ্নতা এবং কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতার দিকে পরিচালিত করে। প্রবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক কাঠামোও প্রভাবিত হয়, কারণ আস্থা নষ্ট হয়ে যায় এবং প্রতারণার ভয় বড় আকার ধারণ করে।
অনলাইন জুয়া প্ল্যাটফর্মগুলো, প্রায়শই বৈধ গেমিং অ্যাপ হিসেবে ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে। ব্যবহারকারীদের ক্রিকেট এবং ফুটবলের মতো খেলাগুলোতে বাজি ধরার রোমাঞ্চ প্রদান করে।
অনলাইন জুয়া মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। জুয়া মূলত একটি প্রতারণার ফাঁদ। তাদের এই প্রতারণার ফাঁদে প্রতিনিয়ত নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো মানুষ। গেছে। তাছাড়া অনেক দিনমজুর লাভের আশায় প্রতিনিয়ত অনলাইন জুয়া খেলে যাচ্ছেন। এই জুয়া বন্ধ করতে মাদক বন্ধে সরকারি হস্তক্ষেপ যেমন ছিল, অনলাইন জুয়ার ক্ষেত্রেও তেমন ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। স্মার্ট বাংলাদেশ, আদর্শ সমাজ, বিবেকবান, সচেতন ও উদ্যমী তরুণদের নিয়ে জাতিকে উন্নত ও সোনার বাংলা গঠন করতে এই অনলাইন জুয়ার আগ্রাসন দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।
মোকাবিলার জন্য সরঞ্জাম সরবরাহ করে। উন্নত ডেটা বিশ্লেষণ এবং সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতারণামূলক লেনদেন শনাক্ত করতে এবং প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে। যাইহোক, এই প্রযুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন মন্থর হয়েছে, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ফাঁক রেখে গেছে। বাংলাদেশ সরকার, ক্রমবর্ধমান এই সংকট সম্পর্কে সচেতন, অনলাইন জুয়া এবং জালিয়াতি রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৬০০টিরও বেশি জুয়া খেলার ওয়েবসাইট ব্লক করা হয়েছে এবং প্রক্রিয়াটি চলমান রয়েছে। তবে জুয়ারিরা ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কের (ভিপিএন) মাধ্যমে ব্লক করা ওয়েবসাইট ও অ্যাপসে প্রবেশ করতে পারছে।
সরকারের এই প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, প্রয়োগ একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রতারকদের অভিযোজন যোগ্যতা এবং প্রযুক্তির সর্বদা বিকশিত প্রকৃতির অর্থ হলো নতুন জুয়া এবং জালিয়াতির প্ল্যাটফর্মগুলো যত তাড়াতাড়ি পুরানোগুলি বন্ধ হয়ে যায় তত দ্রুত অন্য আরেকটি আবির্ভূত হয়। অনলাইন জুয়া এবং জালিয়াতি মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি। পাবলিক এডুকেশন ক্যাম্পেইনগুলো এই ক্রিয়াকলাপগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে দেশে সব ধরনের অনলাইন জুয়া এবং প্রতারণামূলক লটারির সফটওয়্যার বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি ওয়েব অ্যাড্রেস, আইপি কিংবা নাম পরিবর্তন করে যেন নতুনভাবে আবার কার্যক্রম চালাতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিং কম্পানিগুলোর লেনদেনের ওপরও নজর রাখা উচিত। সন্দেহজনক লেনদেন দেখলেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া উচিত।