ভারী বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত চট্টগ্রাম বিভাগে বন্যার শঙ্কা

শেয়ার বিজ ডেস্ক: দেশে বন্যার ক্ষত এখনও শুকায়নি। এর মধ্যেই ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ফের বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেক জেলায় অতিবৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। চলমান বৃষ্টিপাত থেমে থেমে আরও ১০ দিন অব্যহত থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। সমুদ্রবন্দরগুলোয় জারি করা হয়েছে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত। গত জুন-জুলাইয়ের মধ্যমেয়াদি বন্যায় অন্তত ১২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। এরই মধ্যে আবারও বন্যার শঙ্কা ও দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে এমনটা জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। চলতি মাসে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয়। উত্তর বঙ্গোপসাগরে এটি প্রবল অবস্থায় রয়েছে। কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে বলেও জানান তারা।

আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে নোয়াখালীর মাইজদী কোর্টে। সেখানে বৃষ্টি হয়েছে ২৭৬ মিলিমিটার। এরপর এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে পটুয়াখালীতে। সেখানে ২১৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশালে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। সে তুলনায় ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কম। আজ শনিবার বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক। পরশু রোববার থেকে আবার বৃষ্টি বাড়তে পারে।
চাঁদপুর: সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে চাঁদপুরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। এতে শহরের বেশ কয়েকটি সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধতায় ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষ। গতকাল শুক্রবার দুপুরে চাঁদপুর আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক শাহ মুহাম্মদ শোয়েব জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত জেলায় বৃষ্টি হয়েছে ১০৭ মিলিমিটার। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রেকর্ড হয়েছে ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। সন্ধ্যার পরে বৃষ্টিপাত কিছুটা কম হলেও মধ্যরাত থেকে আবার বেড়েছে। বিশেষ করে শুক্রবার ভোর থেকে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যায়। এখন পর্যন্ত বৃষ্টি অব্যাহত আছে।

গত বুধবার দুপুর থেকেই শুরু হওয়া ও থেমে চলা ভারী বৃষ্টির কারণে শহরের নাজির পাড়া, মাদ্রাসা রোড, পালপাড়া, নিউ ট্রাক রোড ও রহমতপুর আবাসিক এলাকায় সড়কে পানি জমে আছে। ড্রেনের মধ্যে ময়লা আবর্জনা জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি কমলে পানি কিছুটা হ্রাস পায়। আবার বৃষ্টি হলে একই অবস্থা। এদিকে বৃষ্টির কারণে প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাসা থেকে বের হয়নি। শ্রমিক-দিনমজুরসহ শ্রমজীবী মানুষের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। কক্সবাজার: কক্সবাজারের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও জেলার নি¤œাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোর কিছু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। জেলার চকরিয়া, রামু ও পেকুয়া উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের এক লাখের অধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পাহাড়ি ঢলের পানি সরে যেতে পারছে না। গত সোমবার থেকে জেলায় হঠাৎ করে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা দেখা দেয়।

জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া রাজারকুল, ফতেখাঁরকুলসহ ৬টি ইউনিয়নের ৫০ হাজার বাসিন্দা এখনও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। বন্যার পানি সরে না যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এ এলাকার মানুষ। চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন জানিয়েছেন, চকরিয়া উপজেলায় মাতামুহুরি নদীবেষ্টিত ইউনিয়নে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। এতে উপজেলার ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। উপজেলার নিচু এলাকায় নতুন করে বন্যার পানি ঢুকেছে। তবে মাতামুহুরি নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তবে চকরিয়া-মানিকপুর, রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কসহ জেলার বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সড়কে বন্যার পানি উপচে পড়ায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলের তোড়ে মাতামুহুরি ও বাকখালী নদীর কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে ঢলের পানি ঢুকে এসব এলাকা প্লাবিত হয় বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

এদিকে, কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়াসহ ১ নম্বর ওয়ার্ডে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি আসা-যাওয়া করায় ওই এলাকার ৫০০ বাড়িঘরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য দ্রুত সরকারি সহায়তা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, সপ্তাহ ধরে ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে যেসব এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে, সেসব এলাকায় ত্রাণসহায়তা পাঠানো হয়েছে। নিজ নিজ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।
ফেনী : গত দুই দিনের টানা বৃষ্টি ও ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম এলাকায় মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার প্রায় ১৫০ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। গতকাল শুক্রবার সকালে পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের শালধর এলাকায় মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে পরশুরাম উপজেলার শালধর, মালিপাথর, পাগলীর কুল এবং ফুলগাজী উপজেলার নিলক্ষী ও মনতলা গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

ফেনীর পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাত দিয়ে জানান, শুক্রবার বেলা দুইটার দিকে মুহুরি নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পরামর্শে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। তবে নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডানিয়া ভূঁইয়া। তিনি বলেন, যেকোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পরামর্শে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহরিয়ার হাসান জানান, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে এক মাস আগে বেড়িবাঁধের কয়েকটি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছিল। সেগুলোর মেরামত চলা অবস্থায় আজ শুক্রবার সকালে বেড়িবাঁধ আবার ভেঙে যায়। বৃষ্টি বন্ধ হলে এবং নদীর পানি কমলে ভাঙনের স্থান আবার মেরামত করা হবে।

খাগড়াছড়ি: মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় খাগড়াছড়িতে দুদিন ধরে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। এতে চেঙ্গী নদীর পাহাড়ী ঢলে প্লাবিত হয়েছে খাগড়াছড়ি সদরের নি¤œাঞ্চল। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার।
গতকাল শুক্রবার সকালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার দ্বিতীয় শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আব্দুর রহিম বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে।’
এর মধ্যে শুক্রবার ভোর থেকে নদীর পানি বাড়তে থাকায় সদরের মুসলিমপাড়া, মেহেদীবাগ, কালাডেবা, গঞ্জপাড়া, ঠাকুরছড়াসহ চেঙ্গী পাড়ের নি¤œাঞ্চলের মানুষের বসতবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে।
দুই মাসের ব্যবধানে তিনবার পানি ঢুকে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নদী ও ছড়ার পাড়ে বসবাসকারীরা। খাগড়াছড়ির পৌর শহরের বাসিন্দা আয়েশা আক্তার বলেন, ‘আমার ঘর বাড়ি তলিয়ে গেছে। ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে নাপ্পি বাজারে এসে বসে আছি। কোনো সহযোগিতা পাইনি।’
আরেক বাসিন্দা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘এই নিয়ে তিনবার ঘর ডুবছে। ভোর থেকে পানি ঢোকা শুরু হয়েছে। ঘর-বাড়ি সব শেষ। কোনো সহযোগিতা আগেরবারও পাইনি।”

শহরের আরেক বাসিন্দা তোফায়েল মিয়া বলেন, হঠাৎ পানি ঢুকে ঘরের জিনিসপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি না নামলে পানি কমারও সম্ভাবনা নেই। বৃষ্টি বাড়লে দুর্ভোগও আরও বাড়বে।” এদিকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় দীঘিনালার মাইনী নদীর পানিও বাড়তে শুরু করেছে। তলিয়ে গেছে দীঘিনালার মেরুং ও কবাখালীর নদীপাড়ের কৃষিজমি। এছাড়া ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসের শঙ্কায় রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবার।
জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, প্রবল বর্ষণে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় দুর্গত মানুষদের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জানান তিনি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০