আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদে হস্তক্ষেপ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

রোহান রাজিব: বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পর ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও (এনবিএফআই) সুদহার বাড়াতে শুরু করেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ ব্যাংকের চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বরাবরই বেশি হয়ে থাকে। এমন অবস্থায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের সুদে হস্তক্ষেপের চিন্তা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে গত সপ্তাহে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বৈঠকও হয়েছে। বৈঠকে ব্যাংকের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে সুদহার কীভাবে নমনীয় সীমায় রাখা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এক্ষেত্রে রেফারেন্স রেট ঠিক করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদে একটা মার্জিন দেয়ার কথা জানানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই মার্জিন ২ শতাংশের মধ্যে রাখা হতে পারে। আগামী এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথা জানা গেছে।

জানা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির আওতায় ঋণের সুদহার বাড়ানোর পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে কয়েক দফা নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আইএমএফের পরামর্শে গত মে মাসের শুরুতে সব ধরনের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে গত ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাজারে ঋণের চাহিদা ও ঋণযোগ্য তহবিলের জোগান সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ঘোষণার পরই ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সুদহার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। সূত্রগুলো বলছে, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চরম দুরবস্থা বিরাজ করছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে।

আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের লুটপাটের শিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে পুরো খাতই আস্থার সংকটে পড়েছে। অন্যদিকে লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এ কারণে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই তারল্য সংকটে ভুগছে। এমন অবস্থায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বেশি সুদের প্রলোভনে কিছু কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমনত সংগ্রহ করছে। আর আমানত সংগ্রহে তহবিল সংগ্রহে খরচ বাড়ায় ঋণ বিতরণেও বেশি সুদারোপ করছে তারা। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতে আসার পর আগের মতোই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদে একটা মার্জিন দেয়ার চিন্তা করছে।

এ বিষয়ে গত বুধবার ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজি ছাইদুর রহমান। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে নেতৃত্ব দিন এ খাতের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো বলছে, বৈঠকে ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটা রেফারেন্স রেট নির্ধারণ হবে। বর্তমানে বিভিন্ন খাতে ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ যে সুদ উঠেছে, এ রকম শীর্ষ কয়েকটি ব্যাংকের রেট গড় করে রেফারেন্স রেট ঠিক করা হবে। ওই রেফারেন্স রেট থেকে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ মার্জিনে ঋণ দেয়ার সুযোগ পাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিএএফসিএর চেয়ারম্যান জানান, আমানতের সুদ বেড়ে গেছে, ট্রেজারি-বিল বন্ডের সুদও ঊর্ধ্বমুখী। তাই এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঋণের সুদ নির্ধারণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যাতে ঋণগ্রহীতার জন্য বোঝা না হয়। এই সুদ ব্যাংকের চেয়ে একটু বেশি হবে। এই মার্জিনটা ২ শতাংশের মতো রাখার চিন্তা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটা আগেও ছিল। যদি মার্জিনই দেয়া হয়, তাহলে সুদহার বাজারভিত্তিক থাকবে কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে নির্দিষ্ট করে কোনো মার্জিন বেঁধে দেয়া হচ্ছে না। শুধু বলা হয়েছে, সামঞ্জস্য করে সুদারোপ করতে, যাতে গ্রাহকের ওপর বোঝা না বাড়ে। ব্যাংক ঋণের সুদ যদি ১২ শতাংশ হয়, আর সেটা যদি আমরা ১৬ শতাংশে দিই, তাহলে আমাদের কাছে গ্রাহক আসবে না।

ঋণের সুদ তো বাজারভিত্তিক করা হয়েছে গত মে মাসে। তাহলে এত দিন কোন রেট ফলো করে সুদারোপ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত মে পর্যন্ত স্মার্ট পদ্ধতির আওতায় একটা রেট ছিল। সেই রেটকে ফলো করেই আমরা ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ফলে ঋণের সুদ খুব একটা বাড়েনি। জানা যায়, বাজারের ওপর ছাড়ার আগে স্মার্ট’ বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সুদহার নির্ধারিত হতো। গত বছরের ১ জুলাই ওই পদ্ধতি চালু করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ পদ্ধতিতে ছয় মাসের (১৮২ দিন) ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক করা হতো রেফারেন্স রেট। ওই পদ্ধতি চালু হওয়ার পর হতে কয়েক দফায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ ও আমানতের সুদহার পুনর্নির্ধারণ করা হয়। গত এপ্রিল থেকে স্মার্ট রেটের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ বিতরণ করার সুযোগ পায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানলো। ওই সময় স্মার্ট রেট ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ফলে এপ্রিল মাসেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সুদহার সাড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

এখন বাজারভিত্তিক করার পর কোন কোন প্রতিষ্ঠানের সুদহার ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বলেন, মার্জিন কত হবে সেটা নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগে রেফারেন্স রেট ঠিক করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপর ওটার ওপর মার্জিন দেয়ার বিষয়টি আসবে। বর্তমান বাস্তবতায় কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই মার্জিনটা আড়াই থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে রাখা না গেলে তার পক্ষে সারভাইভ করাটা কঠিন। এজন্য আমাদের সার্বিক কস্ট অব ফান্ড এবং আর কত শতাংশে ঋণ দিলে আমরা সারভাইভ করতে পারব; সেটা বিবেচনায় নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০