খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা

রোহান রাজিব: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত সোমবার গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী সরকারের পতন হয়। এ সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৫৯ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা বা ৭১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। এখানে বছরের পর বছর ধরে খেলাপিদের নানা ধরনের ছাড় দেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে বারবার। আইন সংশোধন করে একাধিকবার ঋণ তফসিলের সুবিধা দেয়া হয়েছে। আর এসব সুযোগ-সুবিধা নিয়েই খেলাপির তালিকা থেকে বড় বড় ঋণখেলাপি বাইরে থেকে গেছেন, হয়েছেন আরও ক্ষমতাবান। আওয়ামী লীগ গত জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ২০১০ সালে তা সামান্য বেড়ে হয় ২২ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে।

ওই বছর শেষে খেলাপি ঋণ কমে হয় ২২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ২০১২ সালে খেলাপি ঋণ ২০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয় ৪২ হাজার ৯০ কোটি টাকা। ২০১৩ সাল শেষে খেলাপি ঋণ দেড় হাজার কোটি টাকা কমে হয় ৪০ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় আমলে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছিল। দ্বিতীয় আমলের পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ বাড়ে ৫৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ৯ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৫০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ৯ হাজার ২৪০ কোটি বেড়ে হয় ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দুই হাজার ৭৮০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ১২ হাজার ১৩০ কোটি বেড়ে হয় ৭৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা।

শেখ হাসিনার ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়ে ৫২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মাত্র ৪০০ কোটি বেড়ে হয় ৯৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে পাঁচ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা কমে হয় ৮৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। আবার ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৫৪০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে হয় এক লাখ তিন হাজার ২৭০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২২ সালে ১৭ হাজার ৩৮৬ কোটি বেড়ে হয় এক লাখ ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি বেড়ে হয় এক লাখ ৪৫ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।

আওয়ামী লীগ গত বছরের জানুয়ারিতে চতুর্থবারের মতো পাঁচ বছরের জন্য সরকার গঠন করে। তবে ছয় মাসের মাথায় গণ-আন্দোলনের মুখে গত সোমবার শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে থেকে পালিয়ে যান। এই সরকারের পতনের আগে মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ রেখে যান এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ৩৬ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। তবে শেষ তিন মাসের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের সুবিধা দেয়া হয়েছিল। এ সময় সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হওয়া সংজ্ঞা হচ্ছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা। দেশে প্রথম খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। তবে পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞাটি ছিল ১৯৯৪ সালের। এর পর থেকে যতগুলো সরকার এসেছে, সবাই এর সংজ্ঞা নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেলাপি হওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আবার খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ কতবার পুনঃতফসিল করা যাবে, তারও পরিবর্তন করা হয়েছে বেশ কয়েকবার।

২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর শুরুতে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যেমন, ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে বলেছিল, কোনোভাবেই তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালাটিও ধরে রাখতে পারেনি। প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপে পিছু হটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। প্রভাবশালী ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে। সে সময় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেয়া হয়। তখন নিয়ম ছিল তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যায় না। কিন্তু বেশিরভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন। এরপরেই ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেয়া হয়। ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্পগ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তারপরও এসব গ্রুপের বেশিরভাগই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেনি।

২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার আবার বদল হয়। ঋণ পরিশোধের সময় আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। একই সময় ঋণ অবলোপন বা রাইট অফের ক্ষেত্রেও বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। তবে ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের ইতিহাসে ঋণখেলাপিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটি দেন। সে সময় দুই শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রাখা হয়। নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেয়া হয়, এর মধ্যে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। সেই সুযোগ নেয়া বেশিরভাগই পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

এছাড়া করোনা মহামারির কারণে এর আগে ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যা চলতি বছরে তুলে নেয়া হয়। এর ফলে দুই বছর ঋণ পরিশোধ না করেও অনেকেই ভালো গ্রাহকের তালিকায় ছিল। আর এখন ছাড় উঠে যাওয়ার পর অনেকেই ঋণ পরিশোধ করছেন না। আবার যেসব ঋণ এর আগে খেলাপি হওয়ার কারণে পুনঃতফসিল করা হয়েছিল, সেই ঋণের কিস্তিও শোধ হচ্ছে না। এতেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০