নামমাত্র প্রকৃত মুনাফা: ১৩৬ কোম্পানির শেয়ারে ঠকছেন বিনিয়োগকারী

ব্যাংকের সুদহার কমতে থাকায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে পুঁজিবাজারে। উচ্চ লভ্যাংশের হার দেখে অনেকে প্রভাবিতও হচ্ছেন। তবে এসব শেয়ারের প্রকৃত মুনাফার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন না অনেকেই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। তাই বিভিন্ন কোম্পানির প্রকৃত মুনাফাচিত্র তুলে ধরতে ধারাবাহিক আয়োজন। আজ ছাপা হচ্ছে প্রথম পর্ব

 

ইসমাইল আলী ও নাজমুল ইসলাম ফারুক: তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে ব্যাংক আমানতের সুদহার। এ হার এতই কম যে, তা নেমে গেছে মূল্যস্ফীতির হারেরও নিচে। এজন্য বিকল্প উৎস হিসেবে অনেক আমানতধারী পুঁজিবাজারমুখী হচ্ছেন। তবে কোন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন, তা নিয়ে অনেকেই রয়েছেন দ্বিধায়। কারণ তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি প্রকৃত মুনাফার হার (ইল্ড) ব্যাংক সুদহারের চেয়েও কম। এমনকি ৩০০-৬৫০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ দিলেও বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে প্রকৃত মুনাফা মিলছে ছয় শতাংশের কম।

ইয়াহু ফাইন্যান্সের ভাষ্যমতে, কোনো কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের আয়ের যে অংশ দেয়, তা হলো লভ্যাংশ। এটি সাধারণত শেয়ারপ্রতি আয় প্রকাশ করে। তবে বিভিন্ন কোম্পানির লভ্যাংশের হারের মধ্যে তুলনায় ব্যবহার করা হয় ইল্ড বা প্রকৃত মুনাফা। এক্ষেত্রে লভ্যাংশকে শেয়ারমূল্য দিয়ে ভাগ করে প্রকৃত মুনাফা নির্ণয় করা হয়।

ইয়েল্ডের গ্রহণযোগ্য কোনো হার না থাকলেও বাজারের অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে তুলনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে ইয়াহু বিজনেস। তবে মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক সুদহারের চেয়ে ইল্ড বেশি হওয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোর গড় সুদহার পাঁচ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে পাঁচ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকে ১০০ টাকা জমা রাখলে বছর শেষে তার প্রকৃত মূল্য ১৭ পয়সা কমে যাবে। তাই প্রকৃত মুনাফার হার বর্তমানে সাড়ে পাঁচ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যমতে, তালিকাভুক্ত ৩২৯ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে লভ্যাংশ দিচ্ছে ২৭৫টি। এর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে ২০৪টি। তবে ৬৭ শতাংশ বা ১৩৬টির প্রকৃত মুনাফার হার সাড়ে পাঁচ শতাংশের নিচে। বাকিগুলোর প্রকৃত মুনাফা সাড়ে পাঁচ শতাংশের বেশি।

অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, বাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা দুই ধরনের গেইন করতে পারেন ক্যাপিটাল ও ডিভিডেন্ড গেইন। ব্যাংকে আমানতের সুদহার আগের চেয়ে কমায় পুঁজিবাজারমুখী হচ্ছেন অনেকেই। এতে বাজার ভালোর দিকে যাচ্ছে। আর এ বাজারে ক্যাপিটাল গেইনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে কোম্পানিগুলোর উচিত বছর শেষে এমন ডিভিডেন্ড দেওয়া যাতে তার প্রকৃত হার ভালো মানের হয়। আর বিনিয়োগকারীদের উচিত কোম্পানির সার্বিক অবস্থা দেখে বিনিয়োগ করা। এতে মুনাফা না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে।

তথ্যমতে, যেসব কোম্পানির লভ্যাংশের হার পাঁচ দশমিক ৩৩ শতাংশের কম, তাদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ব্যাংক খাতও রয়েছে। এ খাতের ব্যাংকিংয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফার হার অনেক কম। সমাপ্ত ২০১৫ সালে সাত শতাংশ নগদ এবং আট শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর অনুযায়ী ২০১৫ সালে ট্রাস্ট ব্যাংকের শেয়ারে প্রকৃত মুনাফা দাঁড়ায় দুই দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া ঢাকা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফার হার তিন দশমিক পাঁচ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের তিন দশমিক ৭২ ও ব্র্যাক ব্যাংকের পাঁচ দশমিক ১৩ শতাংশ।

এদিকে নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত লভ্যাংশের হারের দিক দিয়ে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স। কোম্পানির শেয়ারে প্রকৃত মুনাফার হার দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক ৪০ শতাংশ। এরপরই ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) অবস্থান। প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত লভ্যাংশ হার দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক ৬৬ শতাংশ। এছাড়া খাতটির ডিবিএইচের প্রকৃত মুনাফার হার দুই দশমিক ৮১ শতাংশ, আইডিএলসির তিন দশমিক ৯৩, লংকা-বাংলা ফাইন্যান্স পাঁচ দশমিক ১৭, ন্যাশনাল হাউজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স চার দশমিক ৪৯, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল তিন দশমিক ৪৫ ও উত্তরা ফিন্যান্স চার দশমিক ৯৩ শতাংশ।

শুধু ব্যাংক বা আর্থিক খাতই নয়, বহুজাতিক সবগুলো কোম্পানির প্রকৃত মুনাফার হারও সাড়ে পাঁচ শতাংশের নিচে। যদিও কোম্পানিগুলো অধিক হারে লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানির। ২০১৫ সালের সমাপ্ত বছরে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫৫০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। তবে গত এক বছরে কোম্পানির শেয়ার সর্বোচ্চ তিন হাজার ৮২ টাকা ৮০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। এতে প্রকৃত লভ্যাংশের হার দাঁড়িয়েছে এক দশমিক ৮৬ শতাংশ।

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রকৃত লভ্যাংশ হার এক দশমিক ৯৪ শতাংশ, বাটা সু কোম্পানি লিমিটেড দুই দশমিক ৪৩, লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের দুই দশমিক ৭২, গ্ল্যাস্কোস্মিথ বাংলাদেশ লিমিটেডের তিন দশমিক শূন্য ছয়, রেকিট বেনকিজার (বিডি) লিমিটেডের চার দশমিক শূন্য চার, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের হার তিন দশমিক ৫৭ ও হাইডেলবার্গ সিমেন্টের প্রকৃত লভ্যাংশের হার পাঁচ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

এ সম্পর্কে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, 01 বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা দুই ধরনের গেইন করেন। এর মধ্যে একটি হলো ডিভিডেন্ড গেইন, অপরটি ক্যাপিটাল গেইন। ধরুন একটি কোম্পানির শেয়ারদর ২০ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বছরশেষে ডিভিডেন্ড দিয়েছে ২৫ শতাংশ। তার ডিভিডেন্ডের প্রকৃত হার হবে পাঁচ শতাংশ। এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীরা ডিভিডেন্ড গেইন করতে পারেন। এ কারণেই কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে বুঝেশুনে বিনিয়োগ করা উচিত।

তিনি আরও বলেন, বাজারে যত দরেই বেচাকেনা হোক না কেন, একটি কোম্পানির শেয়ারের ফেসভ্যালু ১০ টাকা ধরেই ডিভিডেন্ডের হার নির্ণয় করা হয়। তবে কোনো কোম্পানির ভিত্তি ভালো হলে তার শেয়ারদর কখনও অনেক বাড়তি থাকতে দেখা গেছে। এমন কোম্পানিগুলো বছর শেষে ৫০০ শতাংশ লভ্যাংশও দিতে দেখা যায়। তবে বেশি দামি শেয়ারের যত বেশি ডিভিডেন্ডই দেওয়া হোক না কেন, তাতে বিনিয়োগকারীরা ডিভিডেন্ড গেইন করতে পারেন না। সেসব শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটাল গেইন করতে হবে।

এদিকে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের সবচেয়ে আলোচিত কোম্পানির নাম জেমিনি সি ফুড। শেয়ারদর মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক বাড়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে একাধিকবার নোটিস দেওয়া হয়। অথচ লভ্যাংশের দিক থেকে এ খাতের সর্বনি¤œ অবস্থানে রয়েছে জেমিনি সি ফুড। কোম্পানিটির ২০১৫ সমাপ্ত বছরে প্রকৃত লভ্যাংশের হার দাঁড়ায় দশমিক ২২ শতাংশ। খাতটির বাকি সবগুলো কোম্পানির অবস্থা একই। সবগুলোর প্রকৃত মুনাফাই তিন শতাংশের নিচে।

জ্বালানি খাতের আলোচিত কোম্পানি সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর গত এক বছরে সর্বোচ্চ ৩৩৫ টাকা ৪০ পয়সায় বেচাকেনা হয়। কোম্পানিটি জুন ২০১৬ সমাপ্ত বছরে ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। যার প্রকৃত লভ্যাংশের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ খাতের কেপিসিএল ছাড়া বাকিগুলোর প্রকৃত মুনাফার হার ব্যাংক সুদহারের (সাড়ে পাঁচ শতাংশ) নিচে।

বিমা খাতের ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ২০১৫ সমাপ্ত বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ২০ শতাংশ নগদ ও ২০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। এতে প্রকৃত লভ্যাংশের হার দাঁড়ায় দশমিক ৮০ শতাংশ। এ খাতের অগ্রণী, কন্টিনেন্টাল, ডেল্টা লাইফ, ইস্টল্যান্ড, গ্রীন ডেল্টা, জনতা, মেঘনা লাইফ, পপুলার লাইফ, পাইওনিয়ার, প্রগতি, প্রাইম লাইফ, প্রভাতী, রিলায়েন্স, রূপালী, সোনার বাংলা, তাকাফুল লাইফ ও ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্সের প্রকৃত মুনাফার হারও অনেক কম।

ওষুধ ও রসায়ন খাতের অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যাল পুঁজিবাজারে ঢাকঢোল পিটিয়ে এলেও প্রতিষ্ঠানটির ২০১৬ সমাপ্ত বছরে প্রকৃত লভ্যাংশের হার দাঁড়ায় এক দশমিক শূন্য চার শতাংশ। আলোচিত সময়ে অ্যাকটিভ ফাইন বিনিয়োগকারীদের জন্য পাঁচ শতাংশ নগদ ও ৩০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয়। গত এক বছরে কোম্পানিটি শেয়ারদর সর্বোচ্চ ৫৮ টাকা ৪০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। এছাড়া কোহিনুর কেমিক্যালের ২০১৬ সমাপ্ত বছরে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ নগদ ও ২০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয়। আলোচিত বছরে কোম্পানিটির প্রকৃত লভ্যাংশ হার দাঁড়ায় দশমিক ২৮ শতাংশ। গত এক বছরে কোম্পানির শেয়ার সর্বোচ্চ ৪৮৮ টাকা ৯০ পয়সায় বেচাকেনা হয়। এ খাতের বাকি কোম্পানিগুলোর প্রকৃত মুনাফার হারই পাঁচ শতাংশের নিচে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল্ কোম্পানি লিমিটেড ২০১৬ সমাপ্ত বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। আর প্রকৃত লভ্যাংশের হার দাঁড়ায় দশমিক ৯১ শতাংশ। কোম্পানিটির গত এক বছরে সর্বোচ্চ ১২৭ টাকা ১০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। আর ইউনিক হোটেলের প্রকৃত লভ্যাংশ তিন দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।

এদিকে বস্ত্র খাতের সর্বনিম্ন লভ্যাংশের হার দাঁড়িয়েছে আলহাজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের। প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত লভ্যাংশের হার দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ খাতের এপেক্স স্পিনিং, আনলিমা ইয়ার্ন, এনভয়, ফারইস্ট নিটিং, এইচআর টেক্স, হাওয়েল টেক্সটাইল, মডার্ন ডায়িং, সায়হাম টেক্সটাইল, সায়হাম কটন, স্কয়ার টেক্সটাইল, স্টাইল ক্রাফট ও জাহিন টেক্সটাইলের প্রকৃত মুনাফা চার শতাংশের নিচে।

এর বাইরে সিমেন্ট খাতের সাতটি, প্রকৌশল খাতের ২০টি, বিবিধ খাতের ছয়টি, পেপার ও প্রিন্টিং খাতের দুটি, সেবা ও রিয়েলস্টেট খাতের তিনটি ও ট্যানারি খাতের তিনটি কোম্পানি নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। তবে প্রতিটি কোম্পানির প্রকৃত মুনাফাই পাঁচ শতাংশের নিচে।

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০