আন্দোলনে স্থবির রাজস্ব আদায় এনবিআরের কার্যক্রমে ভাটা

রহমত রহমান: বিদায়ী অর্থবছর প্রায় তিন লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়করের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এমন অস্থিরতার মধ্যেও এই বিপুল রাজস্ব আদায় হয়েছে। যাদের শ্রম, ঘাম আর মেধায় এই রাজস্ব আদায় হয়েছেÑতারাই পদোন্নতি, পদায়ন ও বঞ্চনার শিকার। বর্তমান চেয়ারম্যানের পাঁচ বছর মেয়াদে বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী এই বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে এই চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে এনবিআরসহ সারাদেশে ভ্যাট কমিশনারেট, কাস্টম হাউস ও কর অঞ্চলে আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনের ফলে রাজস্ব আদায় তো হচ্ছে না, বরং সব কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে রয়েছে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানির প্রতিদান স্বরূপ তিনবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ লাভ করেন এই চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানকে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা পদত্যাগ করলেও তিনি পদত্যাগ করেননি কেন? চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ছাড়া রাজস্ব আদায় স্বাভাবিক হবে না বলে জানিয়েছেন তারা।

অপরদিকে চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামা কর্মীরা এবার ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি পদ না ছাড়লে বুধবার থেকে একযোগে এনবিআরসহ সারাদেশের ভ্যাট কমিশনারেট, কাস্টম হাউস ও কর অঞ্চলে লাগাতার কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনবিআর ভবনের সামনে যৌথভাবে এ ঘোষণা দেন বাংলাদেশ ইন্সপেক্টর অব ট্যাক্সেস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতারা। এছাড়া দাবি আদায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টাকে একটি স্মারকলিপি দেয়া হবে।

অপরদিকে এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হওয়ার পেছনে এনবিআর চেয়ারম্যানের দায় আছে। জাতীয় রপ্তানির ধারা অব্যাহত রাখতে রপ্তানিমুখী বাণিজ্যিক সংগঠনের মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। গতকাল রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এই সভার আয়োজন করে পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়ক পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএপিএমইএ)। সভায় ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এনবিআরের আমূল সংস্কার করতে হবে; ব্যবসায়ীদের হয়রানি ও অত্যাচার বন্ধে এনবিআর কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেয়ার দাবি করেন তারা।

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর এনবিআরকে রাজস্ব আদায় করতে হবে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আদায়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ ও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ ১২ মাসে এনবিআরকে আদায় করতে হবে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রতিমাসে ৪০ হাজার কোটি এবং প্রতিদিন আদায় করতে হবে প্রায় এক হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।

এনবিআরের সদস্য ও মাঠপর্যায়ের একাধিক কমিশনার শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস বা জুলাই মাস থেকে আদায়ে পরিকল্পনা করা হয়। বেশিরভাগ অফিস প্রথম মাস থেকে রাজস্ব আদায়ে কঠোর হয়, যার ফলে আদায় বেশি হয়। কিন্তু এবার জুলাই মাস শুরু হয়েছে আন্দোলন দিয়ে। জুলাইয়ের প্রথম থেকেই কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। আর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে আন্দোলন আরও তীব্রতা লাভ করে। আর মাসের শেষে এসে আন্দোলন ও সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ বহু মানুষ হতাহত হয়। যদিও ৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। আন্দোলনের কারণে আমদানি-রপ্তানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়েছে। এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট, আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ও আয়কর আদায় করা যায়নি বললেই চলে। এক মাসে যদি ৪০ হাজার কোটি টাকা টার্গেট থাকে, আর প্রতিদিন এক হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। আন্দোলনের কারণে প্রথম মাসে অর্ধেক রাজস্ব আদায়ও সম্ভব হবে না। এছাড়া সরকার পতনের পর জ্বালাও-পোড়াওয়ের কারণে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালু করলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ভয়ে এখনও চালু হয়নি। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় একেবারে কমে যাবে।

সদস্য ও কর কমিশনাররা বলছেন, সরকার পতনের পর নতুন করে যোগ হয়েছে এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন। কাস্টমস, ভ্যাট, আয়কর ও এনবিআরÑসব জায়গায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই চেয়ারম্যানের পাঁচ বছর মেয়াদে পদোন্নতি, পদায়ন ও অধিকারবঞ্চিত হয়েছেন। হয়রানি ও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করতে চেয়ারম্যানের সহযোগী ছিলেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা কয়েকজন কর্মকর্তা। চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীদের পদত্যাগের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশিরভাগ আন্দোলন করছেন। প্রতিদিন এনবিআরের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করছেন। এছাড়া যারা কমিশনারেট, কর অঞ্চল ও কাস্টম হাউসে রয়েছেন, তাদেরও বেশিরভাগ কাজে যোগ দিচ্ছেন না। মাঠে ভয় থাকায় অনেকেই ভ্যাট ও কর আদায়ে যাচ্ছেন না। তাদের অধিকার ফিরে না পেলে বা চেয়ারম্যান পদত্যাগ না করলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। আর রাজস্ব আদায়ও গতি পাবে না।

এনবিআরের কয়েকজন সদস্য শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে এনবিআরেও আন্দোলন হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পদোন্নতি ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন এই চেয়ারম্যান, যার ফলে বেশিরভাগ আন্দোলন করছেন। এতে এনবিআরের স্বাভাবিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। অনেক সদস্য ও কর্মকর্তারা অফিস করছেন না। ফলে জরুরি ফাইল থাকলেও তা পড়ে রয়েছে। কোনো সিদ্ধান্ত কর্মকর্তারা না দেয়ায় মাঠ অফিসগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। তারাও চেয়ারম্যানের পদত্যাগের মাধ্যমে এই স্থবিরাবস্থার অবসান চেয়েছেন।
আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, এনবিআর চেয়ারম্যান হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। প্রথমে দুই বছরের জন্য নিয়োগ পান। নিয়োগ পাওয়ার পরপরই তিনি বড় কয়েক কোম্পানিকে কোটি কোটি টাকার সুবিধা দেন। এছাড়া প্রথম চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানির করার এজেন্ডা নেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হতে গিয়ে ইউনূসের বিরুদ্ধে একের পর এক আয়কর মামলা দিয়ে হয়রানি শুরু করেন। আয়কর আইনে সাধারণত তিন বছর পর্যন্ত অডিট করা যায়। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট ১০ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত এবং তারও বেশি সময় ধরে অডিট করে। ইউনূসকে হয়রানির প্রতিদান হিসেবে ও প্রধানমন্ত্রীর এক আস্থাভাজন আত্মীয়কে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে দ্বিতীয়বার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান এই চেয়ারম্যান।

নিয়োগ পাওয়ার পর আবারও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। আবারও একই কায়দায় ইউনূসকে হয়রানি শুরু করেন। অথচ অনেক বড় বড় গ্রুপ ও কোম্পানি শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এলেও তিনি কোনো কর্ণপাত করেননি। বহু প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি উদ্ঘাটিত হলেও অজানা কারণে চেয়ারম্যান তা এগিয়ে নিতে দেননি। তৃতীয়বার ড. ইউনূসকে হয়রানি করা সামনে রেখে এবং প্রধানমন্ত্রীর এক আত্মীয়ের দোহাই দিয়ে চার বছরের জন্য নিয়োগ পান। নিয়োগ পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তার ভয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কথা বলতে সাহস পেতেন না। তার ইশারায় তার কয়েকজন কর্মকর্তা কোনো পদোন্নতি দেননি। বিশেষ করে কর্মচারীদের কোনো পদোন্নতি দেননি। এই চেয়ারম্যানের পরপর তিন মেয়াদে ছয় বছরের সময় বর্ধিতকরণে কমপক্ষে চারজন সচিব হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং লাইন ধরে প্রতিটি ক্ষেত্রে ছয় কর্মকর্তা সহকারী সচিব থেকে সচিব হওয়া পর্যন্ত বঞ্চিত হয়েছেন।

অপরদিকে দেশের অক্সিজেন রাজস্ব আহরণ করে এনবিআর। সেই অক্সিজেন আহরণে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নিষ্পেষিত, অবহেলিত ও বঞ্চনার শিকার। সময়মতো পদোন্নতি নেই, মেধার মূল্যায়ন নেই, সঠিক জায়গায় পদায়ন নেই, অটোমেশন নেই, সংস্কার নেইÑএক দপ্তরে এমন ‘নেই, নেই’ কেবল একটি কারণে; তা হলোÑএনবিআর চেয়ারম্যান। এনবিআর চলে মূলত দুটি ক্যাডারের (কর, শুল্ক ও আবগারি) ওপর ভর করে। কিন্তু এনবিআর পরিচালনা করেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা এক সচিব। এই সচিব দুই বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও এই আমলা শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর সম্পর্কে জেনে উঠতে উঠতে দুই বছর লেগে যায়। এর ফলে এনবিআরকে দেয়ার মতো এই আমলার কিছুই থাকে না। সেজন্য এই দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরম বৈষম্যের শিকার হন। বৈষম্য নিরসনে এবার দুই ক্যাডার থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগের দাবি জানানো হয়েছে। সম্প্রতি বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশন পৃথকভাবে বৈঠক করে এসব দাবি জানিয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০