রোহান রাজিব: চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন বেসরকারি খাতের সাতটি ব্যাংকসহ মোট ৯টি ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা বন্ধ করল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবে টাকা না থাকলেও অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে চেক ক্লিয়ারিংয়ের বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সুবিধার মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। তবে এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ হারাতেই বিশেষ সুবিধা বন্ধ করা হলো। গত সপ্তাহে ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের ৮৪৮ কোটি টাকার বেনামি ঋণ আটকে দেয়া হয়। নতুন করে এসব ব্যাংক আর গ্রুপটির কোনো ঋণও ছাড় করছে না।
জানা যায়, ৯টি ব্যাংকের ১ কোটি টাকার বেশি চেক অন্য ব্যাংকগুলোকে উপস্থাপন বা ক্লিয়ারি না করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত সোমবার রাত ৮টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট সব ব্যাংকের ব্যাচ ম্যানেজারদের কাছে মৌখিকভাবে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। মূলত এস আলমের বেনামি ঋণ আটকাতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অথচ এতদিন ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকার পরও যেকোনো পরিমাণের চেক ক্লিয়ারিং করার সুযোগ দিয়ে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা ও বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ব্যাংকগুলো হলোÑ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবং পদ্মা ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম সাতটি ব্যাংকের মালিক চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী এস আলম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের এমডি বলেন, আমরা ৯টি ব্যাংকের ১ কোটি টাকার বেশি চেক উপস্থাপন বা সম্মাননা দিতে মৌখিকভাবে একটি নির্দেশনা পেয়েছি। তবে অফিশিয়াল কোনো চিঠিপত্রের মাধ্যমে দেয়া হয়নি। যেহেতু এটা প্রজ্ঞাপন বা লিখিত চিঠি নয়, তাই ওইসব ব্যাংকের সঙ্গে আমরা ওয়ান টু ওয়ান কথা বলেছি। একইসঙ্গে চেক ক্লিয়ারিং বা আরটিজিএসে ওই ব্যাংকের পেমেন্ট থাকলে তা তাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, এমন কোনো নির্দেশনা নেই। তবে ব্যাংকগুলো এখন সার্বিক পরিস্থিতির কারণে বড় চেক নেয় না।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সরকার পরিবর্তনের পর বেনামি ঋণের মাধ্যমে অর্থ তুলে নেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। আর এসব ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময় এস আলম বেনামি ঋণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছে। তাই এখন যাতে কোনো বেনামি ঋণের টাকা বা বড় কোনো অঙ্কের টাকা অবৈধভাবে তুলে না নিতে পারে। তাই এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জানা যায়, সরকার পরিবর্তনের পর বেনামি ঋণের মাধ্যমে বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক এক দিনেই ব্যাংকটি ৮৮৯ কোটি টাকা উত্তোলনের চেষ্টা চালিয়েছে। তবে ব্যাংক তা ঠেকিয়ে দিয়েছে। এসব অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টা করছিল গ্লোডেন স্টার ও টপ টেন ট্রেডিং হাউস নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। কর্মকর্তারা জানান, দুটি প্রতিষ্ঠানই ব্যাংকের মালিকপক্ষের সঙ্গে যুক্ত। এ জন্য সরকার পরিবর্তনের ফলেই তারা এভাবে অর্থ তুলে নেয়া ঠেকিয়ে দিতে পেরেছেন।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায় সোনালী, জনতা, রূপালী, পূবালী ও সিটি ব্যাংকের পাঁচটি চেক নগদায়নের জন্য পাঠানো হয়। গ্লোডেন স্টার নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই পাঁচটি চেক ইস্যু করেছিল। প্রতিষ্ঠানের মূল হিসাব ছিল আগ্রবাদ শাখায়। ওই পাঁচটি চেক আগ্রাবাদ শাখার ম্যানেজার প্রাথমিক অনুমোদন দেয়ার পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে ৩৪৬ কোটি টাকা তুলে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের তৎপরতায় তা আটকে যায়। একই দিন টপ টেন ট্রেডিংয়ের ৫৪৮ কোটি টাকার বেনামি ঋণও আটকে দেয় ব্যাংকটি।
এদিকে এস আলমের মালিকানাধীন সাতটি ব্যাংকসহ মোট ৯টি ব্যাংকের অবস্থাই নাজুক পরিস্থিতি। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক অনেক দিন ধরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ তারল্য (এসএলআর) সংরক্ষণ করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সংরক্ষিত চলতি হিসাবেও বিপুল ঘাটতি নিয়ে চলছে তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ১৬ মে পর্যন্ত পাঁচ ব্যাংকে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১৫ হাজার ৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৮ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ১১ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৩৬ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ২ হাজার ২৪ কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ১৬২ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এসব ব্যাংকে যে পরিমাণ আমানত জমা হয়েছে, তারা এর চেয়ে অনেক বেশি ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগ করেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি আরও বড় আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ বিবেচনায় এসব ব্যাংককে জামানত ছাড়াই টাকা ধার দিচ্ছে এবং লেনদেন হিসাব চালু রেখেছে। এ কারণেই মূলত নতুন ঋণ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছিল ব্যাংকগুলো।
বর্তমানে এসব ব্যাংকের বিপুল পরিমাণের ঘাটতি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর এ ঘাটতি জন্য অনেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকর সদ্য পদত্যাগ করা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে দায়ী করেছেন। কারণ তার ক্ষমতা বলে এ সুবিধা দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে আব্দুর রউফ তালুকদারের খোঁজ মিলছে না। গত শুক্রবার অজ্ঞাত স্থান থেকে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান। তাই এই ঘাটতি কিভাবে মিট করা হবে তা নিয়েও ইতোমধ্যে প্রশ্নে উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ঘাটতি থাকা এসব ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ধার সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু এসব টাকা আবার ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে বের করে নেয়া হয়। তাই এখনো ব্যাংকগুলো সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে না।