দুর্নীতি-অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতায় ঝুঁকির মুখে বিদ্যুৎ খাত!

**বিদ্যুৎ খাতে গত ১৫ বছরের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছে শেয়ার বিজ। এতে দুর্নীতি-অনিয়ম ছাড়াও ভর্তুকি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। এ খাতের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ নিয়ে আজ থাকছে ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ছিল বিদ্যুৎ খাত। দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য সে সময় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়া শুরু করে সরকার। প্রথমে তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লাইসেন্স দেয়া হয়। পররবর্তী সময়ে ১৫ থেকে ২২ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ঝোঁক দেয় সরকার। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন থেকে পরিচালনা প্রতিটি পর্যায়েই ছিল দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা।

বিদ্যুৎ খাত শুরু থেকেই অপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হতে থাকে। ১৫ বছরে তিনটি মাস্টারপ্ল্যান করা হলেও সেগুলো ছিল অনেকটাই বাস্তবতা বিবর্জিত। এরপরও মাস্টারপ্ল্যান বাদ দিয়ে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লাইসেন্স দেয়া হয়। আর এসব বিষয় নিয়ে যাতে কোনো ধরনের আইনি প্রশ্ন না উঠে এজন্য ২০১০ সালেই বিতর্কিত দায়মুক্তি প্রণয়ন করে সরকার। ২ বছরের জন্য প্রণীত আইনটির নাম ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’।

যদিও পরে কয়েক দফা আইনটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২ বছর, ২০১৪ সালে ৪ বছর, ২০১৮ সালে ৩ বছর এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ৫ বছরের জন্য আইনটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২১ সালে সংশোধন করা আইনটি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) আইন, ২০২১’ ২০২৬ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরের জন্য আইন করা হলেও তা ১৫ বছর ধরে চলছে।
দায়মুক্তি এ আইন বিদ্যুৎ খাতকে আইনগত সুরক্ষা দিচ্ছে। আইনটির ‘আদালত, ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ’ উপশিরোনামে ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ উপশিরোনামে ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’

‘এই আইনের অধীন গৃহীত কাজের হেফাজত’ উপশিরোনামে ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি।’ উল্লিখিত তিনটি ধারা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এ আইনের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংক্রান্ত দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত কাউকেই বিচারের আওতায় আনা যাবে না। যদিও এ আইনটি বাতিল নিয়ে বর্তমানে আলোচনা চলছে।

এদিকে এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়াই দেয়া হয়েছে ৯০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লাইসেন্স। মাত্র একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দরপত্রের মাধ্যমে নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। যদিও ওই দরপত্রে একটিমাত্র কোম্পানি অংশ নেয়ায় তাতে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। এতে দরপত্র জমা দেয়ার শেষ মুহূর্তে ফিন্যান্সিয়াল প্রপোজাল বদলে দেয় কোম্পানিটি। ফলে দরপত্র আহ্বান করলেও বেশি দরেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের লাইসেন্স পায় সামিট পাওয়ার। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছে আনসলিসিটেড তথা অযাচিত প্রস্তাব যাচাইয়ের মাধ্যমে। এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জও নির্ধারণ করা হয় দরকষাকষির (নেগোসিয়েশন) মাধ্যমে। ফলে এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ২০১০ সালে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ায় তা ২০১৫ সালে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে ২০১৬ সালে প্রণীত দ্বিতীয় মাস্টারপ্ল্যানের প্রক্ষেপণ অনুযায়ীও বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি। এতে বছরের বড় একটা সময় বসে থাকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চলার জন্য লাইসেন্স দেয়া হলেও বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে ৫০ শতাংশের কম। তবে চাহিদা না থাকলেও একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়। ফলে বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকছে। বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা ঠেকেছে ২৭ হাজার ৫১৫ মেগাওয়াটে। কিন্তু উৎপাদন করা হয় সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট।

এদিকে নিজস্ব কেন্দ্র বসে থাকলেও ভারত থেকে নিয়মিত চলছে বিদ্যুৎ আমদানি। বর্তমানে ভারত থেকে দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। অর্থাৎ সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ১৮% আসছে ভারত থেকে। তবে এ বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিয়ে রয়েছে ঝুঁকি। কারণ ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের বিল পুরোটাই দিতে হয় ডলারে। আর ডলার সংকটের কারণে বর্তমানে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল বকেয়া পড়েছে পাঁচ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা বা ৪৮ কোটি ৫১ লাখ ডলার। এর মধ্যে আদানির বিলই সবচেয়ে বেশি বকেয়া, যার পরিমাণ তিন হাজার ২৮৪ কোটি টাকা।

মূলত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করতে তার ঘনিষ্ঠ ভারতের দুটি শিল্প গোষ্ঠী আদানি ও রিলায়েন্স গ্রুপকে দেয়া হয় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লাইসেন্স। এর মধ্যে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায়; যার সক্ষমতা এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চুক্তি নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। দেশীয় কোম্পানিগুলোর বাইরে আদানিকে নানাভাবে বাড়তি সুবিধা দেয়া হয় চুক্তিতে। এতে আদানির বিদ্যুৎ কেনায় খরচও পড়ছে দেশীয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি। আর রিলায়েন্সকে দেয়া হয়েছিল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স। ১০০ কোটি ডলারে নির্মিত ৭১৮ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি শিগগিরই উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। যদিও গ্যাস তথা এলএনজি সংকটে দেশীয় বিভিন্ন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়মিতই বসে থাকছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে বরাবরই গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অথচ দেশের গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে নিয়মিতই এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এছাড়া কয়লাও আমদানি করতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য। এতে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। এক্ষেত্রে বরাবরই নবায়নযোগ্য উৎসকে উপেক্ষা করা হয়। তবে গত দুই-তিন বছর নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে কয়েকটি। এসব কেন্দ্রের বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে অনেক বেশি। এগুলো নিয়েও এরই মধ্যে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে উচ্চ হারে। আবার রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য অনুমোদন দেয়া হলেও পরে এগুলোর চুক্তি কয়েক দফা নবায়ন করা হয়েছে। এতে কেন্দ্রগুলো চলেছে ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত। আর তিন বছরে নির্মাণব্যয় উঠে যাওয়ার পরও এসব কেন্দ্রে প্রতিবারই ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয় ডলারের ভিত্তিতে। এতে বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে সরকারের খরচও বেড়ে গেছে।

এখানেই শেষ নয়, বেসরকারি খাতের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেয়া হয়েছে তিন থেকে ২০ বছর পর্যন্ত করমুক্ত সুবিধা। এতে উচ্চ হারে মুনাফা করলেও বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কোনো আয়কর দিতে হয় না। উপরন্তু তেল আমদানিসহ নানা খাতে বাড়তি সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের সময় ৯০ শতাংশ ঋণ সুবিধা পেয়েছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। আবার ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে এসব ঋণের পুরোটা সরকার পরিশোধ করে দেয়। এতে অনেকইটাই কইয়ের তেলে কই ভাজার মতো সুবিধা পায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
বিদ্যুৎ খাতের এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে পিডিবির বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানদের কেউই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিদ্যুৎ খাতের সব অনিয়মের পেছনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে। এছাড়া পিডিবির বেশকিছু সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এসব অনিয়মের সুবিধাভোগী। সময় এসেছে বিদ্যুৎ খাতকে ব্যাপকভাবে সংস্কারের মাধ্যমে এসব অনিময়-দুর্নীতি দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণের।

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম. শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুৎ খাত ব্যাপকভাবে সংস্কার করা প্রয়োজন। এজন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা যেতে পারে, যারা বিদ্যুতের প্রতিটি চুক্তি থেকে শুরু করে সবকিছু বিশ্লেষণ করবে এবং তার ভিত্তিতে সুপারিশ প্রণয়ন করবে। সরকারকেও সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের দায়মুক্তি আইন বাতিল করতে হবে, যাতে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০