ত্রিপুরায় বাঁধ খুলে দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার ভারতের

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি জেলায় হঠাৎ ভয়াবহ বন্যার কারণ হিসেবে ভারতের বাঁধ খুলে দেয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে দেশটির সঙ্গে যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ সরকার। গতকাল সচিবালয়ে অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের এক বৈঠক শেষে ত্রাণ ও দুর্যোগ উপদেষ্টা ফারুকী আজম সাংবাদিকদের একথা বলেন। তবে ভারত বাঁধ খুলে দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি অতিবৃষ্টিতে বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে।

ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর অবিরাম বৃষ্টিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫০ উপজেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন। আট জেলার চার লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা।

উজানে ভারতের বাঁধ খুলে দেয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমের শেষে ভাদ্র মাসে দেশে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েক নেতা ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডাম্বুর বাঁধ খুলে দেয়াকে বন্যার কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও হয়েছে।

বিষয়টি ভারত সরকারের নজরে এলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডাম্বুর বাঁধ খুলে দেয়াকে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতির কারণ হিসেবে বর্ণনা করে বাংলাদেশে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, তা আমরা দেখেছি। এটা তথ্যগতভাবে সঠিক নয়।’ গতকাল এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতে গোমতী নদীর সংলগ্ন এলাকায় গত কয়েকদিনে চলতি বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাঁধের ভাটি এলাকার পানির কারণে বাংলাদেশের বন্যা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ডাম্বুর বাঁধ সীমান্ত থেকে অনেক দূরে, বাংলাদেশের ১২০ কিলোমিটার উজানে। প্রায় ৩০ মিটার উচ্চতার এই বাঁধের মাধ্যমে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে। সেখান থেকে ত্রিপুরা হয়ে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পায় বাংলাদেশ।’ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ‘২১ আগস্ট থেকে পুরো ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোয় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ব্যাপক অন্তঃপ্রবাহের কারণে পানি নিজে থেকে বের হওয়ার ঘটনা দেখা গেছে।’

বাংলাদেশ থেকে উজানে ১২০ কিলোমিটার নদীপথে তিনটি পানির পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকার কথা বলা হয়েছে বিবৃতিতে। যার মধ্যে অমরপুর স্টেশন থেকে দ্বিপক্ষীয় প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশকে বন্যার হালনাগাদ তথ্য দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার তথ্য ২১ আগস্ট বিকাল ৩টা পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টায় বন্যার কারণে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় যোগাযোগে সমস্যা তৈরি হয়।’ এ পরিস্থিতিতে জরুরি তথ্য আদান-প্রদানের জন্য অন্যান্য উপায় ব্যবহার করে যোগাযোগ চালু রাখার চেষ্টা করার কথা বলেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন নদীতে বন্যা একটি যৌথ সমস্যা যা উভয় পক্ষের জনগণের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করে এবং এর সমাধানের জন্য ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। যেহেতু দুটি দেশের ৫৪টি অভিন্ন আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে; তাই নদীর পানিবিষয়ক সহযোগিতা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পৃক্ততার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা দ্বিপক্ষীয় পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে পানিসম্পদ ও নদীর পানি ব্যবস্থাপনার সমস্যা ও পারস্পরিক উদ্বেগসমূহের সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

এদিকে গতকাল সচিবালয়ে ভারতের বাঁধ খুলে দেয়ার বিষয়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ উপদেষ্টা ফারুকী আজমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটার বিষয়ে যোগাযোগ হচ্ছে। সঠিকভাবে এ বিষয়ে এখন বলতে পারছি না এবং এটা শুনেছি ওপারে বাঁধ খুলে দেয়া হয়েছে। সরকারিভাবে বিস্তারিত জানি না। বাধ খোলা হয়েছে এটা পত্রপত্রিকায় লিখেছে, বিভিন্ন মাধ্যমে আসছে। সরকারিভাবে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হচ্ছে।’
বন্যার আগে বাংলাদেশ কোনো পূর্বাভাস পেয়েছিল কি নাÑসংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা পেয়েছিলেন কি না সংশ্লিষ্টরা জানবেন। আমি তো ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের, আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আর এটা নিয়ে আজকে (উপদেষ্টাদের বৈঠকে) আলোচনাও হয়নি। বন্যা পুরাই আকস্মিক। কেউ কেউ বলছে, আমাদের ওপরে, উজান থেকে পানি আসছে, উজান থেকে মানে ভারতীয় অঞ্চল থেকেও পানি নেমে আসছে। এটা বন্যা যেরকম প্রাকৃতিকভাবে হয়, এটা দ্রুতই হয়েছে। পরিস্থিতি আমরা যেরকম পেয়েছি, গতকাল (বুধবার) সকাল থেকে বিকাল থেকে যেভাবে পানি বেড়ে যাচ্ছে, অনেক জায়গায় যাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতেও যাওয়া যাচ্ছে না।’

এদিকে ত্রিপুরায় বাঁধ খুলে দেয়ার বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, উচ্চতার কারণে পানি উপচে পড়েছে। ত্রিপুরায় বন্যাকে খুব নজিরবিহীন বর্ণনা করে হাইকমিশনার বলেন, বন্যার ফলে ৫০ হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এত বৃষ্টিপাত হয়েছে, এটা ভারতেরও ধারণার বাইরে ছিল। এটি বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দিকেই বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। গতকাল বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন প্রণয় ভার্মা। সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এই কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

প্রসঙ্গত, ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত বৃষ্টিপাতের তথ্য অনুসারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩ দিনে মোট ৪৯০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালিত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত কুমিল্লা জেলায় মোট ৪৪৫ মিলিমিটার ও ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় ৪০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

বিশেষ করে ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত দক্ষিণ ত্রিপুরার বাগাফা নামক স্থানে ৩৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যে স্থান বাংলাদেশের ফেনী জেলার পাশেই অবস্থিত।
এই বৃষ্টিপাত ফেনী জেলার মুহুরী নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই দিনে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্যান্য স্থানে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সময়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি নামক স্থানে ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে; যা বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার সুরমা নদীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০