বাজার ব্যবস্থাপনায় নতুন চাওয়া পাওয়া

আফসারুল আলম মামুন: দেশ আজ নতুন এক সমীকরণে দাঁড়িয়ে। বিগত সরকারে হাজারও মিথ্যা স্তম্ভকে ভেঙে নতুন স্বদেশ গড়তে প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা এবং সঠিক বাস্তবায়ন। বিগত সরকারে আমলে দেশ নিমজ্জিত ছিল নানা ধরনের সিন্ডিকেটের দখলে। বাজার থেকে মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে হাসপাতাল, সব জায়গায় প্রভাবশালীরা এক অদৃশ্য জাল বিছিয়ে রেখেছিল। যার প্রভাবে অতিষ্ঠ ছিল দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।

গ্রামের কৃষিপণ্য দিয়েই শুরু করা যাক। প্রত্যন্ত গ্রামে উৎপাদিত ফসল, যেখানে বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ টাকা। সেই ফসল শহরের ভোক্তার কাছে আসতে আসতে হয়ে যায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে যেটা ছাড়িয়ে যায় ১০০ টাকার ওপরে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কৃষকরা তাদের নায্যমূল্য পান না; কিন্তু অজানা এক প্রভাবে শহরাঞ্চলে একজন নিম্ন বা মধ্যবিত্তকে পুড়তে হয় অদৃশ্য এক আগুনে। যে আগুন চোখে দেখা যায় না কিন্তু পুড়তে হয়ে নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাজারও খেটে খাওয়া মানুষকে। কারণ গুলশান বনানীতে বাস করা উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে ১০ টাকার জিনিস ১ হাজার হলেও গায়ে বাধবে না, কিন্তু কড়াইল বস্তিতে ১০ টাকার জিনিস ১৫ টাকা হলেও বুকের একদিকে ব্যথা তৈরি হয়। কেননা ওই ৫ টাকা রাখা ছিল ছেলের স্কুলের বেতনের জন্য। এদেশে উৎপাদকের সঙ্গে ভোক্তার সরাসরি সম্পর্ক না থাকায় এক শ্রেণির মধ্যকরা সহজেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়। এই মধ্যক শ্রেণিরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মুহূর্তেই পণ্যের দাম আকাশচুম্বী করে ফেলে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ জেলা প্রশাসন যেসব অভিযান পরিচালনা করে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য এবং দেশের প্রথাগত আইনে জরিমানার হার তাদের লভ্যাংশের তুলনায় খুবই কম হওয়ায় প্রায়শই দেখা যায় অন্যায়কারী ব্যক্তি পুনশ্চঃ অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। এছাড়া দেখা যায়, দেশের প্রথাগত রাজনৈতিক ব্যক্তির সাহচর্যে থাকার সুযোগে এই ব্যবসায়ীরা অন্যায় করতে আরও ভয় পাচ্ছে না। তদুপরি বাজার নিয়ন্ত্রণে মূল সিন্ডিকেট প্রায়ই ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকে। বাজারের কর্তৃত্ব তাদের হাতে থাকলেও তাদের চেহারা অদৃশ্যমান। শুধু অদৃশ্যই নয়, তাদের আরেকটা মুখোশ রয়েছে, যেটা পড়ে তারা দিব্যি জনসাধারণের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। তাই দেশের স্বার্থে, দেশের প্রত্যেক স্তরের মানুষের স্বার্থে এই শাখের করাতদের তালিকা করে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধুমাত্র জরিমানা দিয়েই দায় শেষ করার দিনকে কবর দিতে হবে।

শুধু কি উৎপাদিত ফসল; আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রেও দেখা যায় আকাশ পাতাল রকমফের। বেসরকারি এক টিভির অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলছে, দেশের সব পর্যায়ে খেজুরের আমদানি মূল্য কেজিপ্রতি ১০০ টাকার বেশি নয়। কিন্তু দিনশেষে খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ক্ষেত্রভেদে কেজি ২ হাজার টাকা। বিগত সরকার যদিও খেজুরের মূল্যের ওপর বিশাল এক ভ্যাট আরোপ করে রেখেছিল তদুপরি আমদানি মূল্য ১০০ থেকে বিক্রয়মূল্য ২ হাজার; যা কখনও মেনে নেয়া যায় না। এছাড়াও দেখা যায়, রাজস্ব ফাঁকি দিতে তারা বিভিন্ন অসদুপায় অবলম্বন করে। কোটি কোটি টাকার রাজস্ব তারা লাখ টাকায় নিয়ে আসে। আর এর পেছনে রয়েছেন একদল রাজস্ব কর্মকর্তা। এই রাজস্ব কর্মকর্তারদের যোগসাজশে দেশ হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। একদিকে তারা দেশের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে অন্যদিকে বাজারে চড়া মূল্যে বিক্রি করছে আমদানিকৃত পণ্য। এ যেন সোনায় সোহাগা অবস্থা। এছাড়া ঋণ খেলাপির কথা না হয় আজ থাক। এদেশের কৃষকের ১০ হাজার টাকার ঋণ মাফ হয় না, চড়া সুদের ঘানি টানতে হয় বছরের পরে বছর। অন্যদিকে আমদানিকারকরা ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান।

দেশের টাকা যখন বিদেশে পাচার হয়, দেশের অর্থনীতি তখন মরণাপন্ন রোগীর মতো দাঁড়ায়। যার থেকে ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব। বিগত সরকারের সময় চালের বাজার, তেলের বাজার, ডিমের বাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার চালাত একেক সিন্ডিকেট। একেক কর্তাব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত হতো এসব বাজার। তাদের একটি সিদ্ধান্তে ডিমের বাজারে থাকত অস্থিরতা, তাদের একটি স্বার্থান্বেষী ষড়ষন্ত্রে চালের বাজারে লেগে থাকত আগুন। যখনই দায়িত্বশীল ব্যক্তি থেকে কোনো প্রশ্ন ছোড়া হতো, সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পক্ষ থেকে অযৌক্তিক উত্তর রেডি থাকত। কিছুদিন আগে তাদের সুন্দর একটি উত্তর ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এদেশে পেঁপের দাম বাড়ার আদৌ কি কোনো যৌক্তিকতা আছে? যার উত্তর দেয়া কখনও সম্ভব নয়। যদিও বিগত সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে বিভিন্ন ফলসহ সবজি উৎপাদনে পৃথিবীর সেরা দশে স্থান করে নিয়েছে।

২০২৩ সালের কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে বাংলাদেশে এখন দেশি-বিদেশি মিলে প্রায় ৭২ ধরনের ফল পাওয়া যায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু ফল উৎপাদনে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ ৩৪ হাজার হেক্টর এবং উৎপাদিত ফলের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৪৩ লাখ মেট্রিক টন। তদুপরি দেশে ফলের দামও সাধারণের নাগালের বাইরে। যদিও এর মধ্যে দেশি ফলগুলোর ভেতর পেয়ারার দাম কিছুটা স্বস্তির জায়গা দেয়। উৎপাদন, বিপণন, সহজলভ্যতা হিসেবে জনগণের চাওয়া প্রতিটি ফল জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে আসুক। যার জন্য প্রয়োজন ফল আমদানিকারকদের সঙ্গে সরকারের কর্তাদের যথাযথ এবং ফলপ্রসূ আলোচনা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। সব ফলে একটি নির্দিষ্ট শতাংশের বেশি লাভ না করা মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

যাতে ভোক্তার সঙ্গে আমদানিকারকও লাভবান হতে পারেন। কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণনের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি কোল্ড স্টোরেজ প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম থাকায় ফসলের প্রাচুর্যতার সময় তার যথাযথ সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। কৃষকরা সনাতন পদ্ধতিতে কিছুটা সংরক্ষণ করলেও যথাযথ প্রক্রিয়ার অভাবে প্রতি বছর দেশে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি থাকার উৎপাদিত ফসল। কোল্ড স্টোরেজ শুধুমাত্র স্থাপন করাই জরুরি বিষয় নয়, এর সঙ্গে প্রয়োজন ব্যবহারের যথাযথ নির্দেশনা এবং স্বল্পমূল্যের জোগানের ব্যবস্থা করা। কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া যদি বেশি হয়ে যায়, তবে দেখা যাবে কৃষকরা তাতে অনুঃসাহিত হচ্ছে বা ফসলের দামও বেড়ে যাচ্ছে। শ্রমিক খরচÑ কৃষকদের জন্য অন্যতম এটি চিন্তার কারণ। শুধু খরচই নয়, প্রয়োজন অনুসারে কৃষি শ্রমিক না পাওয়ার দরুণ দেখা যায় ফসল যথাযথ উৎপাদন এবং বিপণন সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিক নির্ভর কমাতে প্রয়োজন আধুনিক কৃষিজ যন্ত্রপাতি। বাজারে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে তা সাধারণ কৃষকের জন্য আকাশ কুসুম ভাবনা। যেসব যন্ত্রের ব্যবহার দেখা মিলে শুধুমাত্র ব্যবসায়ী মালিকের ফার্ম হাউজে। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের কাছে এসব যন্ত্র দেখা মিলা ভার। তাই নতুন সরকারকে এসব পণ্যের ভতুর্কি নিশ্চিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। ভর্তুকির সঙ্গে ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কৃষকরা সহজেই কৃষিজ যন্ত্রপাতি কিনে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে সচেষ্ট হবেন।

কৃষি উৎপাদনের প্রথম বিপণন ব্যবস্থার দিকেও জোর দিতে হবে। বিপণন ব্যবস্থার সময় যদি, ট্রাক বা লরি ভাড়া বেশি হয়ে যায়, এতেও কিন্তু কৃষিজ পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। তাই ক্যাটল ট্রেনের মতো একটি ট্রেনের নির্দিষ্ট কয়েকটি বগিকে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে কৃষিজ পণ্যের বিপণনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে রাস্তায় অনাকাক্সিক্ষত চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে হবে।

রাস্তায় রাস্তায় পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ নামে জেলা উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি মোড়ে থাকে চাঁদাবাজি। রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা পেটুয়া বাহিনীর ভরণ পোষণের জন্য এই চাঁদাবাজি করে থাকে। ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং পণ্যের দাম হচ্ছে আকাশচুম্বী। শুধু রাস্তায় চাঁদাবাজি নয়, যখন পণ্য বাজারে খালাশ হয়ে তখনও ইজারা সমেত গুনতে হয় আরও ১০ থেকে ১২টি খাতের দরদাম। বিগত সরকারের এক মন্ত্রীর দিকে দৃষ্টি দিলেও আমরা বিষয়টির প্রতি প্রতীয়মান হই। শুধুমাত্র কারওয়ান বাজার থেকেই তার দৈনিক চাঁদাবাজির পরিমাণ ছিল প্রায় কোটি টাকা।

শুধুমাত্র এক রাজনৈতিক ব্যক্তি কেই যখন এক কোটি টাকা দিতে হয়, তা কিন্তু নয়; এর সঙ্গে যুক্ত হবে আরও শত শত পাতি নেতার দাবি। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে কৃষিজ পণ্যের বিক্রয়মূল্যের ওপর এবং মূল্য চলে যায় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। আজ সময় এসেছে নয়া জামানার, দেশের ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে সব কৃষিজ পণ্যের দাম নির্ধারণ করার জন্য একটি দক্ষ কমিটি গঠন করা সময়ের দাবি। কমিটিতে থাকবে আমদানিকারক, সাধারণ কৃষক, কৃষিবিষয়ক সচিব-মন্ত্রী, কৃষি সম্পর্কিত বিজ্ঞানী, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাধারণ ভোক্তারা। আর এরই মাধ্যমে তৈরি হবে কৃষকের ন্যায্য অধিকার সেই সঙ্গে ভোক্তার ন্যায্য অধিকার। তৈরি হবে সাম্যতার এক বাংলাদেশ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০