মো. জিল্লুর রহমান : ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাম্প্রতিক কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে সাতজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিখোঁজ রয়েছেন আরও দু’জন। বন্যার কারণে ত্রিপুরার ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফলে হু-হু করে পানি ঢুকে বাংলাদেশের ১১টি জেলা তলিয়ে গেছে। এতে ১৩ জনের মৃত্যু ও কয়েক লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে।
নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা আমাদের দেশে প্রায় প্রতি বছরই কমবেশি আঘাত হানে। মূলত ১৯৫৪ সাল থেকে এ দেশে বন্যার দাপট শুরু হয়। তখন থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩২টি বড় ধরনের বন্যা আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৭টিকে মহাপ্রলয়ঙ্করী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ১৯৭০, ১৯৯১, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে আঘাত হানে।
বিশেষভাবে সিলেট অঞ্চলে ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে উল্লেখযোগ্য বন্যা হয়। তাছাড়াচলতি ২০২৪ সালের ২৯ মে প্রথম দফা এবং গত ১৭ জুন থেকে দ্বিতীয় দফায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছিল। তবে ২০২২-এর বন্যা ব্যতিক্রম; ১২২ বছরের ইতিহাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জে এমন বন্যা হয়নি। এতে সিলেটের সঙ্গে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অতিরিক্ত দাবদাহে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জিতে তখন রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়। সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে এসে মিশে ভৈরব বা মেঘনা হয়ে সাগরে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয় এবং সিলেট বিভাগের সবক’টি জেলায় প্রবেশ করে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে চলে যায়। প্লাবিত হয় উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব সময় এমনি এমনি আসে না; রবং মানবসৃষ্ট নানা প্রেক্ষাপট ও কারণ তৈরি হওয়ার মাধ্যমে আসে। মানুষের কার্যকলাপের কারণে সংঘটিত জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ভারীবর্ষণ ঘটে চলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরায়ণের ফলে জলাভূমি ভরাট হওয়া, নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়া, নদ-নদী অপদখলে চলে যাওয়া, হাওরের মাঝখানে রাস্তা বানিয়ে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা, নদীগুলো ড্রেজিং না করা ইত্যাদি কারণে এসব অতিবৃষ্টির পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে তা বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফসল, সম্পদ, ঘরবাড়ির পাশাপাশি মানুষকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বন্যার জন্য ভারত মোটেও দায় এড়াতে পারে না। বরং দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। আন্তর্জাতিক আইন, প্রতিবেশীর অধিকার সব কিছুকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলাদেশের ৫৪টি নদীর উৎসমুখে ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধসহ একাধিক বাঁধ ও ড্যাম নির্মাণ করে বাংলাদেশকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে ভারত। বর্ষাকালে আমাদের পানিতে ভাসিয়ে মারছে আর খরায় পানি আটকে দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভূমি বানিয়ে দিচ্ছে।
একসময় এদেশে ১ হাজার ২০০ নদীর কথা শোনা যেত, কিন্তু এখন ২০০ নদীও সচল নেই। সব শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। অনেকগুলোর চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৭১ সালের রেকর্ড অনুযায়ী ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে এখন ৬ হাজার কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি ধ্বংস হয়েছে। সেচের পানির অভাবে কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে জমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে এবং পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রায় ১৭ ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। ভারতের একপেশে নীতির কারণে আরও যে কত ক্ষতি আমাদের হয়েছে, তার হিসাব কয়জনে রাখে!
পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ভারত ত্রিপুরার ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেয়ায় বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা অস্বীকার করেছেন ত্রিপুরার বিদ্যুৎমন্ত্রী রতন লাল নাথ। তিনি বলেন, গোমতী হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্টের গেট খুলে দিয়েছি, এই তথ্য সঠিক নয়। যে প্রচারটা করা হচ্ছে ডুম্বুর গেট খুলে দেয়া নিয়ে, সেটা অপপ্রচার ছাড়া কিছু না। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ২২ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে এক লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ত্রিপুরা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যা হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের তরফে অভিযোগ উঠছে, ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধের জল ছেড়ে দেয়ায় সেই দেশের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এটা তথ্যগতভাবে ভুল। ডুম্বুর বাঁধ ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। সেই বাঁধের উচ্চতা মাত্র ৩০ মিটার, সেখানে যে জল জমা হয় সেটা বাংলাদেশে বন্যার কারণ হতে পারে না।’
একই সুরে কথা বলেছেন, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) বিকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে তার কার্যালয় ‘যমুনায়’ যান ভারতীয় হাইকমিশনার। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের হাইকমিশনার প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন, ত্রিপুরায় অনেক বৃষ্টি হয়েছে। পানির উচ্চতার কারণে বাঁধ থেকে অটোমেটিক পানি রিলিজ হয়েছে। তিনি বলেছেন, ত্রিপুরায় বন্যা অপ্রত্যাশিত যা দুই দেশেরই সমস্যার কারণ।
কিন্তু ত্রিপুরার গণমাধ্যম বলছে ভিন্ন কথা। ত্রিপুরার সংবাদমাধ্যম বোরক টাইমসের খবরে জানা যায়, ১৯৯৩ সালের পর প্রথমবারের মতো ত্রিপুরার ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফলে ত্রিপুরার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হাওড়া নদী বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, ধলাই নদী মৌলভীবাজারে, মুহুরি নদী ফেনী জেলায় এবং খোয়াই নদী সিলেটে প্রবেশ করেছে। এতে কৃষিজমি এবং আবাসিক অঞ্চলসহ অনেক এলাকা এখন পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। হাজার হাজার বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
ত্রিপুরার রাজস্ব সচিব ব্রিজেশ পাণ্ডে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা ও গোমতী জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। ২০ আগস্ট তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় বাগাফায় ৩৭৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার, বেলোনিয়ায় ৩২৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার এবং অমরপুরে ৩০৭ দশমিক ১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বুধবার (২১ আগস্ট) স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত বাঁধের তিনটি গেটের মধ্যে একটি খুলে দেয়া হয়েছে।
খোয়াইয়ের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদনি চন্দ্রন জানিয়েছেন, খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় জেলার দুটি মহকুমা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের নদীর কাছে মাছ ধরা এড়িয়ে চলতে এবং ভূমিধস প্রবণ এলাকা থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাছাড়া ত্রিপুরার গোমতী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার অফিসিয়াল সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে জানিয়েছেন, গোমতী নদীর পানি আরও বাড়তে পারে। ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে সেচ এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদন উভয়ের জন্য একটি অত্যাবশ্যক পানির উৎস। একই পরিস্থিতিতে সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে খোলা হয়েছিল ডুম্বুর বাঁধ। এর ৩১ বছর অতিবাহিত হবার পর ফের বাঁধটি খুলে দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। অবশ্য ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি) মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) জানিয়েছে, ত্রিপুরায় আরো দু’দিন ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। টানা এ বৃষ্টিপাত বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিদ্যমান নিম্নচাপের প্রভাবে এমন ভারী বৃষ্টি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে আইএমডি।
আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধে আমাদের কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যেমন- ১) যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং শক্তভাবে সাহস নিয়ে টিকে থাকতে হবে, ২) বানভাসি মানুষের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়াতে হবে এবং তাদের ত্বরিত পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া নিতে হবে, ৩) কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করা যায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে, ৪) বাংলাদেশের নদ-নদীর নাব্য বৃদ্ধি এবং তা ধরে রাখার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, ৫) ভারতের পানি আগ্রাসন বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হিসেবে উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর উৎস দেশের ভূ-সীমানার বাইরে থাকায় অভিন্ন নদীগুলোর গতিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে প্রতিবেশি দেশ ভারতের সঙ্গে এমন গঠনমূলক উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে তা কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়, ৬) যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করে পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশে বন্যার প্রাকৃতিক কারণ তথা এ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি এসব প্রতিকারের কোনো উপায় নেই। তবে এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই এ অঞ্চলের বন্যা মোকাবিলার উপায় বের করতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল বা অতিবৃষ্টির পানি যত বেশি পরিমাণে এবং যত দ্রুত সময়ে নিষ্কাশন করা যায় সেটি নিশ্চিত করা।
এজন্য এ অঞ্চলের নদীগুলোর তলদেশে জরিপ করে প্রয়োজনীয় স্থানগুলোয় ড্রেজিং করে নদীগুলোর পানিপ্রবাহ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, নদীগুলোর দুই পাড়ে সব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদীর প্রশস্ততা বাড়াতে হবে, নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দেয়া এবং নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে পাথর ও বালি উত্তোলন রোধ করতে হবে, হাওরের সঙ্গে নদীগুলোর সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে, নদীর পাড়ের প্রাকৃতিক প্লাবন ভূমিগুলোয় বসতি স্থাপন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে, বৃষ্টির পানি সাময়িকভাবে ধারণের জন্য জলাধার, নিম্নাচল, পুকুর ভরাট বন্ধ করে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।
মোট কথা, এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় জনদুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির কথা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে এ ধরনের বন্যা মোকাবিলার সব কারিগরি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।