রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা ও বিএনপির একত্রিশ দফা

লেখা: নিজাম উদ্দিন

এক.
বিএনপির বিগত পনেরো বছরে সবচেয়ে রেলিভেন্ট পলিসি ছিল “রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা”। যা বিএনপির একত্রিশ দফা নামে পরিচিত। বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা ঘোষণার পূর্বে গণতন্ত্রপন্থী প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সাথে কথা বলেছে, মতবিনিময় করেছে। বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলেও একটি ভিশন ঘোষণা করেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যা ভিশন ২০৩০ নামে পরিচিত। সেই ভিশনের বেসিক প্রিন্সিপাল ঠিক রেখেই ২০২৩ সালে ১২ জুলাই একটি সংক্ষিপ্ত বার্তা বিএনপি জাতিকে জানিয়ে দেয়। তা হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র সংস্কারের কী করতে চায় তার একটি রুপরেখা। এটা পলিসি ইস্যুতে বিএনপির সবচেয়ে স্মার্ট মুভ ছিল।

ড.ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি দুটো খুব ভালো কাজ করেছে। বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। একটা হলো প্রবাসীদের সাথে বিমানবন্দরে কী ধরনের আচরণ করা হবে এবং তাদের সুযোগ সুবিধা এবং সম্মান সংক্রান্ত, অন্যটি হচ্ছে ড.দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ। কী পরিমাণ দুর্নীতি বিগত পনেরো বছরে হয়েছে তার একটি সারমর্ম তৈরি করাই হবে এই শ্বেতপত্রের কাজ। এই দুটি উদ্যোগ বাস্তবায়ন হচ্ছে দেখে ভালো লাগছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে বিএনপি আজ থেকে এক বছরেরও আগে তাদের রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখাতে খুব স্পষ্ট করে বলেছিল, তারা ক্ষমতায় গেলে বিমানবন্দরে প্রবাসীদের সাথে যে বাজে আচরণটা করা হয় তার আমূল পরিবর্তন করবে। বিএনপির একত্রিশ দফার ১৬ নাম্বার দফায় লিখা আছে -প্রবাসীদের বিমানবন্দরে হয়রানি মুক্ত সেবার বিষয়ে।

বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখার ১২ নাম্বার দফাটা হচ্ছে বিগত পনেরো বছরের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের বিষয়ে। এই সরকারও শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। বিএনপির রাজনীতির ভালো দিক গুলো অনেকের চোখেই পড়ে না। কিন্তু এক বছর আগের বিএনপির পলিসি যখন ড.ইউনুসও গ্রহণ করছেন তখন কী বলবেন?

দুই.
বিএনপির একত্রিশ দফা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি মডেল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে। এতে সন্দেহ নেই। আরেকটি বিষয় আজ চোখে পড়লো। টিআইবি বলছে- বাংলাদেশে দুইবারের বেশি কারো প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিষয়ে। বিএনপিও এক বছর আগে তার রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা ঘোষণায় দুই বারের বেশি কারো প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিষয়ে অঙ্গীকার করেছে। সুতরাং রাষ্ট্র মেরামতের যে আওয়াজ আজ উঠছে এটি বিএনপির রাজনীতির সাথে সাংঘর্ষিক প্রমাণ করার সুযোগ নেই। বরং বিএনপিও সেই কথাই বলছে এতদিন। এর লিখিত প্রস্তাবের মাধ্যমে।

রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখায় বিএনপি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলেছে।যার উচ্চ কক্ষ হবে রাষ্ট্রের সেইসব মানুষের সমন্বয়ে যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে এক্সপার্ট। এর ফলে আইনপ্রণয়নে মেধাবী মানুষের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত হবে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ভারতেরও পার্লামেন্টও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। সব মত, পথ, চিন্তা এবং আদর্শের মানুষের সমন্বয়ে বাংলাদেশে একটি রেইনবো নেশনের (ইনক্লুসিভ সোসাইটি)কথা রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখায় আছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা,দেশে তরুণ মেধাবী প্রজন্মের নেতৃত্বের জন্য নিয়মিত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রী সভার ক্ষমতার চেকস এন্ড ব্যালেন্সের কথা ঐ রুপরেখায় বিএনপি তুলে ধরেছে। সেটা আজ নয়, এক বছর আগে!

তিন.
বিচারপতির অপরাধের বিচার সংক্রান্ত বিষয়ের জন্য বিএনপি তার রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আবার ফিরিয়ে আনার কথা বলেছে। আওয়ামী লীগ এটি সংসদের হাতে তুলে দিয়ে ছিল। পূর্বে এ কাজটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করতো।

আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে সংবিধানের সত্তর অনুচ্ছেদ সংশোধনীর বিষয়েও কথা বলেছে বিএনপি। নিজ দলের বিরুদ্ধে সংসদে কথা বলার অধিকার সীমিত করেছে সংবিধানের সত্তর অনুচ্ছেদ। এটি নিয়েও বিএনপি প্রস্তাব রাখছে।

রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখার ১৫ অনুচ্ছেদে -ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার- এই স্লোগান দিয়েছে বিএনপি। এর বাস্তবতাও প্রাসঙ্গিকতা এখন সমাজের সর্বত্র লক্ষণীয়। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়ে আওয়ামী লীগ মেগা দুর্নীতি করেছে। এদের বিচার করা যাবে না, এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলা যাবে না -এমন আইনও করে গেছে। বিএনপি একত্রিশ দফায় বলেছিল এই দায়মুক্তির আইন বাতিল করবে,প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন করবে।
বর্তমান সরকার মূলত এইসব বিষয় নিয়েই কাজ করছে। সুতরাং বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা পড়লে এটা মনে করার খুব বেশি কারণ নেই যে রাষ্ট্র মেরামতের বেসিক চিন্তা, ভাবনায় বিএনপি খুব বেকডেটেড!

এই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পথচলায় সবচেয়ে বড় বাধা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গুলোর রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ। পরিবর্তনের সময় এসেছে। স্বচ্ছ এবং পরিচ্ছন্ন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সময় এখনই। কাজটা আসলে দিন শেষে রাজনৈতিক দল গুলোকেই মোটাদাগে করতে হবে। বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখার একত্রিশ দফার অনেক গুলো বিষয় নিয়েই কাজ করছে ড.ইউনুসের অন্তর্বর্তী কালীন সরকার। ভালো লাগছে। সমস্যা সমাধানের রাজনীতির সময় এটা,কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাংখা সবখানে। একটি ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই ছাত্র জনতার এই বিপ্লব, এই গণঅভ্যুত্থান। রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা নিয়ে বিএনপির যে দলীয় পলিসি একত্রিশ দফা ২০২৩ সালে ঘোষিত হয়ে ছিল সেটা কতটুকু সময়োপযোগী, এই সময় বলে দিচ্ছে।

নিজাম উদ্দিন, সহ- সভাপতি, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০