রোহান রাজিব: পাঁচ ব্যাংক ও এক ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি আটকা পড়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এতদিন বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের নিয়ন্ত্রণ ছিল। ব্যাংকগুলোকে দেয়া ঋণের এই অর্থও এস আলম গ্রুপ বের করে নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
ব্যাংকগুলো হলোÑ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এছাড়া এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো আভিভা ফাইন্যান্স।
ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি টাকা আটকে আছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে। তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৪৩ কোটি ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৯৯৫ টাকা আটকা পড়েছে। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আটকা পড়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে। ২ হাজার ৯৮২ কোটি ৯০ লাখ ৬৩ হাজার ৯১০ টাকা। এছাড়া এসআইবিএলে আটকা পড়েছে ১ হাজার ১৭ কোটি ৬৬ লাখ ৪১ হাজার ৭১৪ টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৫৪৭ কোটি ২৬ লাখ ১৮ হাজার ১৫৩ টাকা এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১১ লাখ ২০ হাজার ১৯৭ টাকা। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান আভিভা ফাইন্যান্সে আটকা পড়েছে ৬৯০ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। সব মিলিয়ে পাঁচ ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৮ হাজার ২৮০ কোটি ৯৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯৬৯ টাকা আটকে আছে।
কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ইসলামী ব্যাংক আগে অন্য ব্যাংককে ঋণ দিত। তখন ব্যাংকটির পরিস্থিত খুবই ভালো ছিল। তবে এস আলম ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর আস্তে আস্তে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। কারণ ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার পাশাপাশি তার মালিকানাধীন অন্য ব্যাংকগুলোয়ও ঋণ দিয়েছে। এখন ব্যাংকটি ধার করে চলার মতো পরিস্থিতি নেই। ইতোমধ্যে সব ধারের বিপরীতে সিকিউরিটিজ বন্ধক দেয়া হয়ে গেছে।
মাত্র বছর দশেক আগেও দেশের শীর্ষ ব্যাংক ছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। আইনকানুন পরিপালন, গ্রাহককে সেবা দেয়া ও আর্থিক সূচকে অন্য সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল এই ব্যাংক। গ্রাহকের আস্থার কারণে স্থানীয় আমানত কিংবা বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহে এটি সবচেয়ে এগিয়ে ছিল। ব্যাংকটির আকার এতই বড় হয়ে উঠেছিল যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হতোÑইসলামী ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়লে পুরো খাতে ‘পদ্ধতিগত ঝুঁকি’ তৈরি হবে, যা রোধ করা সম্ভব হবে না।
কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। ওই বছর সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইসলামী ব্যাংককে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার উদ্যোগ হিসেবে এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় সদ্য বিদায় নেয়া আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ। এরপর সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
গত বছরের জুন থেকে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এস আলমের বড় ছেলে আহসানুল আলম। ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৭৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
এর মধ্যে ২৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে এস আলমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে এবং বাকি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে নাবিল গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ, ইউনিটেক্স গ্রুপ, অ্যাননটেক্স গ্রুপসহ ২৯টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব ঋণের জন্য চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নথি অনুযায়ী, ১০টি কোম্পানির মাধ্যমে এই শাখা থেকে ৩৫ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে।
এস আলম গ্রুপ এবং এর ছায়া কোম্পানিগুলোÑনাবিল ফুডস, নাবিল অটো রাইস মিলস, এমএস এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালÑইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে ২৯ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে।
গতকাল ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ঋণের বেশি অর্ধেকের বেশি টাকা নিয়ে গেছে এস আলম। ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন চেয়ারম্যানের দেয়া হিসাব মতে, ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এই টাকা বের করতে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর বিভিন্ন অনিয়ম ও সুশাসনের ঘাটতিতে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে ১০টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলো হলোÑ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংক। এর মধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকই ছিল এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন। এছাড়া এস আলমের মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান অভিভা ফাইন্যান্সেরও পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়।
জানা যায়, এস আলম গ্রুপ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৭ সাল থেকে গত জুনের মধ্যে ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার ৭৯ শতাংশই ইসলামী ব্যাংক থেকে।