ফেলানী থেকে স্বর্ণা, ক্ষত আর শুকায় না

সুকান্ত দাস: ২০১১ সালের কুয়াশাজড়ানো জানুয়ারির সকাল। কাঁটাতারে ঝুলছে আমার এক বোনের লাশ। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়ে কাঁটাতারে সাড়ে ৪ ঘণ্টা ঝুলেছিল বোনটি। ওর বয়স ছিল ১৫। হ্যাঁ বলছিলাম ফেলানীর কথা। মোটামুটি সাড়ে ১৩ বছর পরের ঘটনা। গত ১ সেপ্টেম্বর বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার স্বর্ণা দাস। বোনটি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
ছোট্ট মেয়ে স্বর্ণা কোনো চোরাচালানের সঙ্গেও জড়িত নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু সীমান্তে কেন এই মৃত্যু মৃত্যু খেলা? এই আচরণ তো সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সঙ্গে হতে পারে না। এ ধরনের কর্মকাণ্ড জয়েন্ট ইন্দো-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথরিটিস ১৯৭৫-এর বিধানের লঙ্ঘন।

ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশের তিন দিক দিয়ে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সর্ব দিক থেকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে তারা। অস্ত্র, সৈন্য, যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরাসহ প্রায় এক কোটি শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল দেশটি। তখন তাদের জাতীয় অর্থনৈতিক অবস্থা এখনকার মতো ছিল না। তবুও বাংলাদেশ তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়ে পাশে পেয়েছে বন্ধু দেশ ভারতকে। কিন্তু তাই বলে প্রতিনিয়ত সীমান্তে এভাবে মানুষ মারবে এটা হতে পারে না। বাংলাদেশে যে সরকারই থাকুক না কেন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবসময়ই ভালো অবস্থানে থাকে। তবে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে আছে সীমান্ত হত্যা নামক একটি গুরুতর সমস্যা। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ৪,০৯৬ কিলোমিটার (২,৫৪৬ মাইল) দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। এই সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে সীমান্ত হত্যা এক ত্রাসের নাম হয়ে উঠেছে। পূর্বে ভারতের সঙ্গে বহু দীপক্ষীয় সমস্যার সমাধান হয়েছে। ছিটমহল বিনিময়, সমুদ্র সীমা বিরোধ নিষ্পত্তি যার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সীমান্ত হত্যা হয়েই চলেছে।

আয়তনে ভারত অনেক বড় দেশ। ভারতের উত্তর সীমান্তের রাষ্ট্রগুলো হলো চীন, ভুটান ও নেপাল। পশ্চিমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এবং পূর্ব সীমান্তে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অবস্থিত। পাকিস্তান এবং চীন সীমান্তে ভারতের ঝুঁকি সবসময় বেশি। বিশেষত কাশ্মীর এবং লাদাখে প্রায়ই সহিংসতার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখি। এসব এলাকা নিয়ে ভারতের নিরাপত্তা সমস্যা সবচেয়ে বেশি। নেপাল ও ভুটান সীমান্তেও তাদের সমস্যা খুব একটা কম নয়। ভারত যে সীমান্ত নিয়ে সবচেয়ে বেশি নিশ্চিন্ত থাকে তা হলো বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত। কারণ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী কোনো কাজ এই সীমান্তে হয় না। অথচ তাদের দেশের সেনাবাহিনীর হাতে সবচেয়ে বেশি নিহত হয় এই সীমান্তে থাকা বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ। কথায় আছে একজন খারাপ প্রতিবেশী হলো অভিশাপ, যেমনটা একজন ভালো প্রতিবেশী হয় আশীর্বাদ স্বরূপ। বাংলাদেশও তেমনি প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। কারণ গত ১৫ বছরে এই সীমান্তে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী কোনো কার্যক্রম হয়নি। এমন অবস্থায় যেখানে তাদের সেনাবাহিনীর নমনীয় থাকা উচিত, সেখানে তারা পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হত্যা করে। এমনকি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্য নিহত হওয়ার নজিরও আছে।
সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান দেখলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে মারা গেছেন ২০০-এর বেশি বাংলাদেশি। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ। যার মধ্যে গত বছর ২৮ জনের প্রাণহানি ও ৩১ জন মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।


আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসকের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ। ওই বছর ৪৮ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারান, যার মধ্যে ৪২ জন বিএসএফের গুলিতে ও ছয়জন শারীরিক নির্যাতনে মারা যান। এর আগের বছর যে ৪৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে ৩৭ জন বিএসএফের গুলিতে এবং ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনে। গত সাত বছরের মধ্যে বিএসএফের গুলিতে সবচেয়ে কম বাংলাদেশির মৃত্যু হয় ২০১৮ সালে ১৪ জনের।
সরকারি হিসাব মতে, ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ সালে ২৪, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ১৮, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ২৫, ২০১৭ সালে ১৭ জন। এ বছরের ২১ জানুয়ারি বিএসএফের গুলিতে একজন বিজিবি সদস্য নিহত হন।
সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, ২০১৪ সালে সীমান্ত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের দাবির মুখে দিল্লিতে বিএসএফ ও বিজিবির মহাপরিচালকদের বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে সমঝোতায় আসে। সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করার ব্যাপারে ২০১৮ সালের এপ্রিলে দুদেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। কিন্তু তবুও হত্যাকাণ্ড থামছে না। মাস কয়েক আগে ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সীমান্তে হত্যা, আহত ও মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে যৌথ টহল জোরদারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছিল। বাংলাদেশ বর্ডারে অস্ত্র সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন করার কথাও বলা হয়েছিল। অথচ সেই সম্মেলনের পরও পুরোদমে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড চলমান রয়েছে। ভারতের অন্য কোনো সীমান্তে তাদের সেনাবাহিনী কর্তৃক অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের হত্যার এমন নজির নেই।
সীমান্তে মাদক এবং গরু চোরাকারবারিদের তৎপরতা আছে। কিন্তু তাই বলে গুলি করে মানুষ মেরে ফেলতে হবে? যারা অপরাধী তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে কিন্তু হত্যা কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে যে কোনো ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এ বিষয়গুলো দেশের আপামর মানুষকে নাড়া দেয়। হƒদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। মানুষ এগুলো স্বাভাবিকভাবে নেয় না। সাধারণ মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন, সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করা হয়। সীমান্ত হত্যা বন্ধে পূর্বে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে আসছে। কয়েক মাস পূর্বে দেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরেও এ বিষয় ছিল বলে সংবাদমাধ্যমে জেনেছিলাম। কিন্তু অবস্থা কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাইÑএমন। কোনোভাবেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিজিবিকে সীমান্তে পিঠ দেখাতে বারণ করেছেন। আমরা কখনোই সহিংসতা কামনা করি না। কিন্তু দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্ন এলে, সেখানে যেটা করণীয় তাই করতে হবে। পূর্বের মতো অন্যের ঘাড়ে পুরোনো দোষ চাপিয়ে দায় শেষ করলে চলবে না। এ দেশের অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে যেকোনো বিষয়ে পূর্বের ব্যাপার টেনে নিজেদের দায় হালকা করা। সবার আগে দেশ। বাংলাদেশ প্রথম, এই নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে দেশের জন্য যেটা ঠিক সেইটা করতে হবে।
যে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, যাদের সন্তান পিতৃহারা হচ্ছে তার দায় কে নেবে? ফেলানী হত্যা নাড়া দিয়েছিল দেশের মানুষকে কিন্তু সেই বিচারও হয়নি এখনও। সরকারের উচিত এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের পরামর্শ নেয়া এবং সীমান্ত হত্যা রোধে গুরুতর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০