ইসলামে ঋণ পরিশোধ সংক্রান্ত বিধিবিধান

জিয়া উদ্দিন মাহমুদ: ঋণ বা ধার হলো একটি বহুল চর্চিত অর্থনৈতিক পদ্ধতি, যা যুগ যুগ ধরে মানুষ ব্যক্তিগত কিংবা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্যবহার করে আসছে। ঋণগ্রহণ বা ঋণপ্রদান কোনো বেআইনি কিংবা ধর্মীয় নিষিদ্ধ কাজ নয় বরং ঋণদান করাকে ইসলাম ধর্মে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত মহনবী রাসুল (সা.) বলেছেন, মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর কোনো জুলুম করে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণে থাকে, আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে কোনো মুসলমানের বিপদ দূর করবেন, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার বিপদগুলো দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ শেষ বিচারের দিন তার দোষ গোপন করবেন। (বোখারি: ২৪৪২)

মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ২৪৫ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘কে সে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে? আল্লাহ তা তার জন্য বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন। আল্লাহই জীবিকা সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করেন। আর তোমরা তারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ আল্লাহকে ঋণ দেয়ার এ অর্থে বলা হয়েছে, তার বান্দাদের ঋণ দেয়া এবং তাদের অভাব পূরণ করা। তাই হাদিসে প্রকৃত অভাবীদের ঋণ দেয়ার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, কোনো একজন মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে দুবার ঋণ দিলে আল্লাহর পথে সে পরিমাণ সম্পদ একবার সাদকা করার সমতুল্য। (ইবনে মাজহা: ২৪৩০)

ঋণপ্রদান করাকে ইসলাম যেভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে তেমনিভাবে গৃহীত ঋণ ফেরত প্রদানে বিভিন্ন বিধিবিধান আরোপ করেছেন। ইসলামে ঋণ পরিশোধ করা আবশ্যক কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণ হলো আমানতের সমতুল্য আর আমানতের খেয়ানত করা মুনাফিকের লক্ষণ। মহান রাব্বুল আলামিন সুরা নিসার ৫৮ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতগুলো প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও। যখন তোমরা মানুষের কোনো বিচার-মীমাংসা শুরু কর তখন ন্যায়ভিত্তিক মীমাংসা করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে সদুপদেশ দেন। নিশ্চই আল্লাহ সবকিছু শুনেন দেখেন।’ যারা ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করেন না রাসুল (সা.) তাদের জন্য কঠোর বার্তা প্রদান করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের মাল (ধার) নেয় পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা আদায়ের ব্যবস্থা করে দেন। আর যে নেয় বিনষ্ট করার নিয়তে আল্লাহ তাআলা তাকে ধ্বংস করে দেন। (বোখারি: ২৩৮৭)। অপর একটি হাদিসের বর্ণনায় এসেছে মুগিরা ইবনু শো’বা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ তোমাদের ওপর হারাম করেছেন, মায়ের নাফরমানি, কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া, কারও প্রাপ্য না দেয়া এবং অন্যায়ভাবে কিছু নেয়া। আর অপছন্দ করেছেন অনর্থক বাক্য ব্যয়, অতিরিক্ত প্রশ্ন করা, আর মাল বিনষ্ট করা। (বোখারি: ২৪০৮)। সুরা নিসার ১১-১৪ নং আয়াতে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পদ বণ্টনের আগে তার ঋণ পরিশোধ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছেন। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধে ইসলাম কোনো ছাড় দেয়নি।

কোনো ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে রাসুল (সা.) নিজে তার জানাজা পড়াতেন না তার
সাহাবায়ে কেরামদের পড়ানোর নির্দেশ দিতেন। তবে ওই ব্যক্তির ঋণপরিশোধের মতো সম্পদ থাকলে বা অন্য কেউ ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নিলে তিনি জানাজা পড়াতেন। (বোখারি: ২২৮৯) অন্য এক হাদিসে এসেছে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘শহীদ ব্যক্তির সব গুনাহ ক্ষমা করা হয় কিন্তু ঋণ ছাড়া।’ (মুসলিম: ১৮৮৬)। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মৃত্যুর আগেই ঋণ পরিশোধ করা উত্তম বা ঋণ পরিশোধ করা পরিমাণ সম্পদ ব্যবস্থা রাখা। এই বিষয়ে আরেকটি হাদিসে এসেছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, মুমিন ব্যক্তির রূহ তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তা পরিশোধ না করা হয়। (ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ)।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও বর্তমান সমাজে প্রায়শই দেখা যায় বিভিন্ন ব্যক্তি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার পর ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ না দিয়ে টালবাহানা করতে থাকি। ঋণ পরিশোধ না করার কারণে বা ঋণ পরিশোধের ওয়াদা দেয়া সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করায় সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষে মানুষে সম্পর্কেও অবনতি হচ্ছে। ঋণ আদায় করতে না পেরে পাওনাদার দেনাদারের বিরুদ্ধে মামলা করছে। বর্তমানে আমাদের দেশের আর্থিক খাত তথা ব্যাংক ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা। অনেকেই ঋণখেলাপি হবার পর ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধের বিষয়ে আগ্রহী না হয়ে মামলা পরিচালনা করে সময়ক্ষেপণ বা বিভিন্ন টালবাহানা করে ঋণ না দেয়ার চেষ্টায় থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বা ঋণ পরিশোধ করার মতো সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করছেন না। অথচ বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র যার ৯০ শতাংশ মানুষই মুসলিম। এই বিষয়ে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ধনী ব্যক্তির (ঋণ আদায়ে) টালবাহানা করা জুুলম। (বোখারি: ২৪০০)।

এমনকি অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করার মত যথেষ্ট সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করে ঝগড়া বিবাদে, মামলা মোকদ্দমায় পতিত হয়। অথচ এই বিষয়ে আমাদের রাসুল (সা.) বলেছেন, আমার কাছে যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনা থাকত, তাহলেও আমার পছন্দ নয় যে, তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তার কিছু অংশ আমার কাছে থাকুক। তবে এতটুকু পরিমাণ ব্যতীত, যা আমি ঋণ পরিশোধের জন্য রেখে দেই। (বোখারি: ২৩৮৯) তাই আমাদের যাদের ঋণ পরিশোধের সামর্থ রয়েছে অতিদ্রুত তা পরিশোধ করে ফেরা উত্তম। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমদের মধ্যে উত্তম লোক সেই, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে। (বোখারি: ২৩৯৩) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির (যার সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ বেশি) দান-সদকা, জাকাত আদায় করার চেয়ে ঋণ পরিশোধ করা অধিক উত্তম এবং জরুরি বলে ইসলামে আখ্যা দিয়েছে। কারণ লোকদের সম্পদ বিনষ্ট অধিকার কারও নেই।

তবে কেউ এমনভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে যদি ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ে তখন অন্য সামর্থ্যবান মুসলমানের উচিত তার ঋণ পরিশোধ করে দেয়া। ইসলামে জাকাত প্রদানের জন্য ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিয়েছেন। মহান আল্লাহ সূরা তওবার ৬০নং আয়াতে বলেছেন, ‘জাকাত কেবলমাত্র ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্তাকর্ষণ আবশ্যক তাদের প্রাপ্য এবং তা দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এটাই আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’

ঋণগ্রস্ত হয়ে গেলে ঋণ পরিশোধের মনোবৃত্তি পোষণ করে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করলে আল্লাহতায়ালা অবশ্যই ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেবেন। রাসুল (সা.) সবসময় ঋণ থেকে মুক্তি চাওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) এই বলে দোয়া করতেন, হে আল্লাহ। আমি তোমার কাছে গুনাহ ও ঋণ থেকে মুক্তি চাই। একজন প্রশ্নকারী বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আপনি ঋণ থেকে অধিক পরিমাণ পানাহ চান কেন? তিনি জবাব দিলেন, মানুষ ঋণগ্রস্ত হলে যখন কথা বলে মিথ্যা বলে এবং ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে। অর্থ্যাৎ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি মিথ্যা ও ওয়াদা ভঙ্গের মতো পাপ কাজেও লিপ্ত থাকে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) কখনই আমানতের খেয়ানত করেননি, এমন চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী তিনি নব্যুয়ত প্রাপ্তির আগে থেকেই ছিলেন। এই জন্যই আরবের লোকেরা তাকে আল-আমিন নামে ডাকতেন যার অর্থ বিশ্বাসী।

তাই আমরা আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশিত পথেই জীবন পরিচালনা করা উচিত এবং নির্দেশনা মোতাবেক আর্থিক লেনদেন পরিচালনা করা উচিত। এই বিষয়ে মহান রাব্বুল আলামিন সুরা হাশরের ৭নং আয়াতে বলেছেন, ‘রাসুল যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর, তিনি যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করো।’ আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) তার জীবন সায়াহ্নে এসে বিদায় হজের ভাষণে জনতার উদ্দেশ্য করে ঘোষণা দেন, ‘আমি তোমাদের কাছে দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা আঁকড়ে থাকলে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং রাসুলের সুন্নাহ বা জীবন আদর্শ।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০