অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-২৯
মিজানুর রহমান শেলী: বাঙালির কলঙ্ক মোচনের একটি দায় ছিল। বাঙালি অযোদ্ধা জাতি: ম্যাকুলাইয়ের এই দুষ্টুতত্ত¡ ভাঙতে সেদিন রণদার মতো বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের দামাল ছেলেরা জানবাজি রেখেছিল। যদিও মাহবুব-উল আলম তার পল্টন জীবনের স্মৃতি বইতে বাঙালির বিভিন্ন কারণে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে রাজনৈতিক নেতারা বাঙালির সেনাবাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নেতাদের এ প্রচেষ্টার হেতু দিনে দিনে সাধারণের ভেতরও ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন কারণে বাঙালি সৈনিক জীবন বেছে নিলেও বলা চলে তাদের সবার মাঝে বাঙালির কলঙ্ক মোচনের প্রচেষ্টা ছিল। সেনাবাহিনীতে কাজ করার এই সামান্য সুযোগখানি কাজে লাগিয়ে অযোদ্ধা-কলঙ্ক ভুল প্রমাণ করতে পারলেই তাদের একটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। একইসঙ্গে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগটাও ছিল নিবিড় ও মোক্ষ। প্রথম প্রশিক্ষণেই তারা একটি সুনাম কুড়িয়েছিলেন ভারতীয় ভাইসরয়ের মুখ থেকে। তারপর সেই সম্মান বুলন্দ রাখার সংগ্রামে বাঙালি যে সাহস আর সক্ষমতা দেখাতে পেরেছেন, সেই মিছিলে রণদা ছিলেন এক বিশেষ ব্যক্তি-উচ্চতায়।
রণদা প্রসাদ সাহা তার যুদ্ধজীবনের এই অধ্যায়ে ছিলেন বন্দিদশায়। হাশিম বে’র কারাগারে তিনি বন্দি। ১৭ জুলাই যেহেতু হাশিম বে’ তাকে লাইন থেকে বের করে নিজের কাছেই আটকে রাখলেন, তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সামারা যেতে দিলেন না, তাই তার অন্তরটা ছিল বড়ই শীতল, ব্যথাতুর। বাঙালি ভাইদের ফেলে তিনি হয়তো হাশিম বে’র বন্ধুত্ব বেশি একটা উপভোগ করতে পারছিলেন না। কিন্তু হাশিম বে’র হৃদয়ে কি কিছুই বন্ধুত্বের মূল্য ছিল না। কিংবা বন্ধু রণদাকে ভালোবেসে কাছে রাখার ভেতর দিয়েই কি হাশিম বে’ বন্ধুত্বের সত্যিকার মর্যাদা রাখতে চেয়েছিলেন! রণদার মনের খোরাক সেদিন ছিল বাঙালির সঙ্গ। তিনি তা না পেয়ে সুখী হতে পারছিলেন না। ওদিকে হাশিম বে’র হৃদয়েই যে কেন সেদিন বন্ধুত্ব পেয়ে বসলো তা জানা যায়নি। তবে রণদার মানবপ্রেম আর প্রাণপূর্ণ ব্যবহার হয়তো হাশিমের প্রাণে মায়া জাগিয়েছিল। কিন্তু এই প্রেমের প্রতিদান তো বন্দিশালার কুঠুরি হতে পারে না।
যাহোক, অবশেষে আগস্ট মাসের শেষ দিকে বাগদাদে অবস্থিত প্রায় ৩০০ জন অসুস্থ, আহত সৈনিক এবং চিকিৎসক দলকে বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বন্দিবিনিময় দলিল তৈরির পর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে রণদাসহ অন্য বাঙালিরা বসরা এসে পৌঁছেন। রণদা আর বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের আরও ছয় সদস্য বসরা থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর রওনা দিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর বোম্বে হয়ে কলকাতা এসে পৌঁছে। তখন বেলা ৩টা বাজে। হাওড়া রেলস্টেশনে আনুষ্ঠানিকতা হলো। এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায় ফেরত সৈনিকদের নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের সনাতন হিন্দু রীতিতে অভ্যর্থনা দেওয়া হলো।
কিন্তু এই বন্দিবিনিময় দলে তো রণদার থাকার কোনো কথা ছিল না। কেননা রণদার সেই হেনসি বাহিনী তখনও বন্দিশালায় প্রহর গুনছে। রণদার তো তাদের সঙ্গেই সামারা যাওয়ার কথা ছিল। ট্রেনে ওঠার লাইনে তিনিও ছিলেন। সেদিন রণদা ওই লাইনে সামারা গেলে তাদের মতোই বন্দিত্বেও দীর্ঘ প্রহর গুনতেন। হাশিম বে’র হƒদয়ে হয়তো এ ব্যপারটাই সেদিন আছড়ে পড়ে। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন, ক’দিন বাদেই এখানে বন্দিবিনিময় হবে তাতে নিশ্চয় রণদাকে মুক্ত করে দেওয়া যাবে। মুহাম্মদ লুৎফুল হক রণদার এই মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে দৈবক্রম বলেছেন যেন দৈবক্রমেই হাশিমের হৃদয়ে সেদিন বন্ধুত্ব উচ্ছল হয়ে উঠেছিল। রণদা তা সেদিন বোঝেনি। তাই হাশিমের কাছে সকাতর মিনতি করেছিলেন, ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বন্ধুত্বের এই প্রতিদানে সেদিন রণদা খুশিও হতে পারেননি। কিন্তু শত্রুদলের নায়ক বন্ধু হাশিম বে’র চ‚ড়ান্ত বন্দিদশার শেকল যে রণদার জীবনে পয়মন্ত হয়ে উঠবে তা রণদা শেষেই বুঝেছিলেন। এ ব্যাপারে শিশির প্রসাদ সর্বাধিকারী বলেছিলেন, ‘হাসিম বে রণদার ভালো করার জন্যই এরকম করলেন (রণদাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাগদাদে রেখে দেওয়া)। কেননা বাগদাদে থেকে যাওয়ার কারণে রণদা দেড় মাস পরে বিনিময় হয়ে কলকাতা ফিরতে পেরেছিলেন।’
বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্যরা যুদ্ধ থেকে ফেরত আসার পরে ২৯ সেপ্টেম্বর পুরো ভারতে তারাই ছিল আলোচ্য। তাদের বিষয়ে ওই দিন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলো। এর শিরোনাম ছিল ‘বাংলার সবচেয়ে সাহসী সন্তানেরা কুট ও বাগদাদে সৈনিক রণদার দুঃসাহসিকতাপূর্ণ কীর্তি’। এই প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের প্রায় এক পৃষ্ঠা পরিমাণ সংবাদ প্রকাশ হয়। এর বেশিরভাগই ছিল রণদার বীরত্বপূর্ণ কাজের বর্ণনা। হাসপাতাল ও হাসপাতালের বাইরের কর্মকাণ্ডের জন্য রণদা সরকারিভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এজন্য সরকারি আদেশও প্রকাশ পেয়েছিল।
রণদা বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের অন্যান্য সদস্যের কাছে ছিলেন এক কথায় প্রিয়। তার কাজকর্ম, সাহস, পরোপকারিতার মতো সমূহ মানবিক গুণ ছিল অনন্য। এজন্য অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও স্নেহের পাত্র ছিলেন তিনি সবার কাছে। রণদা বন্দিশালায়ও সতীর্থের উপকার ও সাহায্যে সব সময় ছিলেন অগ্রগামী। তার সহযোদ্ধা ফকির চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, যদি গোলাগুলির ময়দানেও কাউকে সমাধিস্থ করতে হতো অথবা গুলিবিনিময় রেখার ভেতর থেকে কোনো আহত সেনাকে বের করে আনতে হতো, এমনকি যদি আহতদের কোনো বহর হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী করতে হতো, তারপর তাদের দিতে হতো প্রাথমিক চিকিৎসা, এ সবখানেই ছিল রণদা অদ্বিতীয়। এমনকি মাঝে মাঝে তিনিই হতেন নেতৃত্বের ঝাণ্ডা। রণদার এই কীর্তি ছিল লোভনীয়। যে কোনো সমর নায়ক ও যুদ্ধপরিকল্পনাকারীর কাছে রণদার মতো লোক ছিল কাক্সিক্ষত। তাই রণদা প্রসাদ সাহার বীরত্ব, সাহস ও মূল্যবান সেবায় মুগ্ধ হয়ে মেসোপটেমিয়ার উচ্চ সামরিক কর্মচারীরা বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ডাক্তার সুরেশ প্রসাদ সর্বাধিকারীকে জানায়, বাংলায় যদি রণদা প্রসাদের মতো আরও বীর যুবক থাকেন, তবে আমরা নিঃসংকোচে ও সাদরে তাদের গ্রহণ করব। যুদ্ধে যে কোনো সতীর্থরাই নিজের বীরত্বকে অন্যের চেয়ে বড় করে বলতে চায়। তবে কিছু বীরকে কোনো সতীর্থই অস্বীকার করতে পারে না। রণদা তার সতীর্থদের কাছে সেই জায়গা দখল করতে পেরেছিলেন। টেসিফোনে তার যুদ্ধে অবদানকে সহযোদ্ধারা কখনও ভোলেননি। ১৯১৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায় রাতে খাবার খাওয়ার আয়োজন হয়। এ সময় যুদ্ধ ফেরত বাঙালি সৈনিকদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, কুট অবরুদ্ধ অবস্থায় সবচেয়ে সাহসী কাজ কোনটি ছিল? একজন সৈনিক কোনো দ্বিধা না করে জবাব দেন, অগ্নিকাণ্ডে রণদার ভ‚মিকাই ছিল তার কার্যকালের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ। ১৯৫৬ সালের ২ অক্টোবর কলকাতায় রণদাকে ৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং অ্যাম্বুলেন্স কোরের প্রাক্তন সৈনিকরা সংবর্ধনা দেয়। সেখানে তারা তাদের প্রাক্তন সহযোদ্ধা রণদা প্রসাদ সাহার মেসোপটেমিয়ার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। ‘মানবতার সেবায় অকৃত্রিম সহজাত প্রবৃত্তি তোমাকে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কর্পসে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ) যোগদানে জাগৃত করেছিল। আর তাই তোমাকে জেনারেল টাউনসেন্ডের বৃগেডে কুট-আল-আমারার অবরোধ দশায় সংযুক্ত হতে হলো। তুমি দেখালে একজন মহান বীরের জাঁকালো সব নৈপুণ্য যখন অন্য সবাই হাতড়িয়ে বেরাচ্ছিল।’
একজন বীর যোদ্ধা কখনও বসে থাকে না। একটির পরেই আরেক অভিযানে নিজের জীবনখানি বুঝে নেওয়ার তাগিদে ছুটে চলে। রণদা প্রসাদ সাহা কলকাতায় বেলা ৩টায় ফের এসে রাতেই তিনি নবগঠিত বাঙালি পল্টনে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর থেকে কিছু দিনের মধ্যে আবার তিনি বেঙ্গল ডাবল কোম্পানিতে যোগ দেবেন বলে আশা করেন। ২৬ সেপ্টেম্বরের আগে তিনটি ব্যাচে বাঙালি পল্টনের মোট ৩৯ রিক্রুট নওশেরায় প্রশিক্ষণে রওনা হন। ২৬ সেপ্টেম্বর রাতেই বাঙালি পল্টনের চতুর্থ ব্যাচের ৪০ জন রিক্রুট নওশেরায় রওনা দেয়। এদিন বিকেলেই তিনি যুদ্ধ থেকে ঘরে ফিরেছেন; শত ক্লান্তি সত্তে¡ও রণদা তাদের বিদায় জানাতে রেলস্টেশনে হাজির হন।
যাহোক, বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর আর রণদার সামরিক জীবনের প্রথম অধ্যায়ের এটা ছিল শেষ অধ্যায়। রণদাসহ আটজন বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্য বন্দিবিনিময়ে ছাড়া পাওয়ার পরে বাকি বন্দিদের বন্দিদশা হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। তারা যুদ্ধবিরতির পরে অর্থাৎ ১১ নভেম্বর ১৯১৮-এর পর ছাড়া পেয়েছিলেন।
যুদ্ধের এই প্রথম পর্বেই বাঙালি দামাল ছেলেরা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে, ম্যাকুলাইয়ের তত্ত¡ ভুল। আর তাই বাঙালি পল্টন গঠন করা হয়েছিল। এভাবেই বাঙালিরা তাদের যথাযথ সম্মান ফিরিয়ে আনলেন। আর এ লড়াইয়ের নায়ক ছিলেন ওই রণদা প্রসাদ সাহা। ব্রিটিশরা অ্যাম্বুলেন্স কোরের কর্মনৈপুণ্যতা আর সাহসিকতা দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যায়। প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর বিয়ারার কোম্পানি’ নামে আরেকটি নতুন শাখা খুলেছিল। এই বিয়ারার কোম্পানি পরিদর্শন করে ভাইসরয় বলেন, মাত্র তিন মাসের প্রশিক্ষণে তোমরা যা অর্জন করতে পেরেছো এবং আমি যা দেখলাম তাতে আমি খুব কৌত‚হল ও আনন্দ বোধ করছি।’ জেনারেল টাউনসেন্ডের কণ্ঠে ব্রিটিশদের স্বীকারোক্তি ফুটে উঠল। তিনি বলেন, ‘মসীজীবী বাঙালি যে সৈনিকের কাজের সম্পূর্ণ উপযুক্ত এ প্রমাণ তারা দিয়েছেন’।
লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com