অপচয় অনিয়ম ও ব্যয় বৃদ্ধির চক্রে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র!

ইসমাইল আলী: পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উৎপাদন শুরু করে ২০২০ সালের ১৫ মে। ওই বছর ৮ ডিসেম্বর উৎপাদনে আসে দ্বিতীয় ইউনিটটি। যদিও এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় ২০২২ সালে। তবে মূল পরিকল্পনার অনেক কিছুই ঠিক থাকেনি বাংলাদেশ-চীনের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
খরচের নতুন নতুন খাত সৃষ্টি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণব্যয় বাড়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এছাড়া বিনিয়োগকৃত মূলধনের জন্য নির্মাণকালে প্রতি বছর ১৬ শতাংশ হারে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আরওআই) নির্ধারণ করা হয়, যা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণব্যয়ের সঙ্গে যোগ করা হয়। এতে বেড়ে গেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণব্যয় ও বছরভিত্তিক ক্যাপাসিটি চার্জ।

তথ্যমতে, পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যৌথ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন লিমিটেড (সিএমসি)। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে দুই কোম্পানি সমান ১০ শতাংশ হারে মোট ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। বাকিটা চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে।
২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে পিজিসিবির সঙ্গে বাস্তবায়নকারী কোম্পানি বিসিপিসিএল বাস্তবায়ন চুক্তি (আইএ) সই করে। একইদিন পিডিবির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিও (পিপিএ) সই করা হয়। এছাড়া ১৬ সেপ্টেম্বর বিসিপিসিএল ও এনডব্লিউপিজিসিএলের মধ্যে জমি ইজারা সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। এর আগে ২৯ মার্চ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে চীনের দুটি কোম্পানির সঙ্গে ইপিসি চুক্তি সই করে বিসিপিসিএল। সে সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫৬ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা (১ ডলার = ৭৮.৪০ টাকা)। এক্ষেত্রে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার কথা ছিল ১২৮ কোটি ডলার।

যদিও পরের বছর (২০১৭ সালের) জুনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০০ কোটি ডলার বা ১৬ হাজার কোটি টাকা (১ ডলার = ৮০ টাকা)। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণ দেয়ার কথা ছিল ১৬০ কোটি ডলার। তবে ২০১৮ সালের ৩ মে চীনের এক্সিম ব্যাংক পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে। সে সময় এর সম্ভাব্য নির্মাণব্যয় ধরা হয় ২৪৮ কোটি ডলার। তবে সে ব্যয় চূড়ান্ত ছিল না।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধনের পর পুনরায় নির্মাণব্যয় প্রাক্কলন করে বিসিপিসিএল। এতে নির্মাণব্যয় দাবি করা হয় ২৫২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। তবে সে দাবির বিভিন্ন খাত যাচাই-বাছাইয়ে কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ওই কমিটি সব বিষয় যাচাই-বাছাই শেষে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণব্যয়ে বেশকিছু বিষয় কাটছাঁট করে।

এতে দেখা যায়, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৪১ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা (১ ডলার = ১০৬ টাকা)। এতে নির্মাণব্যয় বেড়ে গেছে ৮৫ কোটি ডলার। তবে বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে দেশীয় মুদ্রায় নির্মাণব্যয় বেড়েছে ১৩ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা বা ১০৯ শতাংশ। নির্মাণব্যয় বৃদ্ধির অনুপাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত অর্থবছর কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে চার হাজার ২৯২ কোটি টাকা।

সূত্রমতে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকালে ১৬ শতাংশ হারে আরওআই নির্ধারণ করা হয়। এতে ১২ কোটি ৭১ লাখ ডলার ধরা হয়েছে নির্মাণব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যদিও এটি মূলত চুক্তির দুর্বলতা। এর বাইরে প্রয়োজন না থাকলেও ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বিলাসবহুল এক ক্যান্টিন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এটি নির্মাণব্যয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হয়নি পিডিবি। আবার এক্সিকিউটিভ রেস্ট হাউস ও ভিআইপি রেস্ট হাউজের বাইরে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর জন্য ভিভিআইপি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মূল চুক্তিতে তিনটি কয়লা সংরক্ষণাগার তৈরির কথা ধরা ছিল। ৪৫ দিনের কয়লা মজুত রাখার জন্য এগুলো নির্মাণ করা দরকার ছিল। তবে প্রকল্পের আওতায় চারটি কয়লা সংরক্ষণাগার নির্মাণ করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্মাণকালীন এসব অনিয়ম ছাড়াও নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জনবল নিয়োগে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। দরপত্র ছাড়া বিভিন্ন কাজের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে অর্থ অপচয় ও আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া খোরশেদুল আলম বিসিপিসিএল (পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র) ছাড়াও বিইআরইসিএলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এমডি। যদিও বর্তমানে তার বয়স ৭২ বছর, যা কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন।
অন্যদিকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত জান্নাত আরা হেনরীর লাম এন্টারপ্রাইজ, রাশ অ্যাসোসিয়েটস, ইরা কনস্ট্রাকশন, এনডিই, সালাম এন্টারপ্রাইজ, সুরাইয়া এন্টারপ্রাইজ নামে ভিন্ন ভিন্ন ঠিকাদারকে দরপত্রবিহীন কাজ দিয়েছেন এমডি। এছাড়া বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই অবৈধভাবে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০