তিন মাসে ৪৭ হাজার আমানতকারী হারাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিবেদক: বরাবরই ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) টাকা রাখলে অপেক্ষাকৃত বেশি সুদ পাওয়া যায়। সুদহার বাজারভিত্তিক করার পর এ খাতে সুদের হার আরও বেড়েছে। তারপরও আমানতকারী টানতে পারছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। উল্টো বিদ্যমান আমানতকারীরাও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাাচ্ছেন।

সর্বশেষ চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুনÑএই তিন মাসেই আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন সাড়ে ৪৮ হাজারের বেশি ব্যক্তি আমানতকারী। যদিও একই সময়ে এক হাজারের মতো প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী বেড়েছে খাতটিতে। ফলে সার্বিকভাবে তিন মাসে আমানতকারীর কমেছে সাড়ে ৪৭ হাজারের মতো। আর গত এক বছরের ব্যবধানে কমার এই অঙ্ক ৮৮ হাজার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের অনিয়ম, জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে আগেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা কমেছে মানুষের। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণেও ব্যক্তি আমানতকারীরা হিসাব গুটিয়ে ফেলছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, আস্থাহীনতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তি গ্রাহকরা আমানত তুলে নিচ্ছেন। এ কারণে অ্যাকাউন্ট কমেছে বলে মনে হয়। তবে একই সময়ে বড় বড় করপোরেট গ্রাহকদের আমানত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছে। এ কারণে সার্বিক আমানত বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের জুনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬১টি। চলতি বছরের জুন শেষে যা কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৭টি। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সার্বিক আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৮৮ হাজার ৩২৪টি। এর মধ্যে পুরুষ আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা কমেছে ৬৪ হাজার ৭৩৭টি। আর মহিলা আমানতকারী হিসাব কমেছে ২২ হাজার ৫১৫টি। একই সময়ে পুরুষ প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব কমেছে ১ হাজার ৭৭৩টি। তবে একই সময়ে মহিলাদের প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব বেড়েছে ৭০১টি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চে এ খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৪১ জন। এই হিসাবে গত তিন মাসে আমানতকারী হিসাব কমেছে ৪৭ হাজার ৬০৪টি। এ সময়ে ব্যক্তি আমানকারী হিসাব কমেছে প্রায় ৪৮ হাজার ৬৬৩টি। এর মধ্যে পুরুষ আমানতকারী ৩৮ হাজার ৩১৫ জন ও মহিলা আমানতকারী ১০ হাজার ৩৪৮ জন। তবে আলোচ্য তিন মাসে পুরুষ ও নারী প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী হিসাব বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৫৯টি। এর মধ্যে পুরুষ প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী রয়েছে ৯৬৯টি। আর মহিলা প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী সংখ্যা ৯০টি।

বর্তমানে দেশে ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারল্য সংকটে। অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অন্তত ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন নাজুক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে এ খাতে আমানত সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে মাত্র ৪৩৩ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের বেশির ভাগই ঢাকা বিভাগে। এর পরিমাণ প্রায় ৯২ দশমিক ৫১ শতাংশ।

এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ, রাজশাহীতে ১ দশমিক ০৫ শতাংশ, খুলনায় শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ, সিলেটে শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ, ময়মনসিংহে শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ, রংপুরে শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ এবং বরিশালে শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ রয়েছে। অন্যদিকে গত বছরের জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছিল ৭২ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের জুন শেষে দাঁড়ায় ৭৪ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে আমানত বাড়েনি। বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মে জর্জরিত এ খাতে খেলাপি ঋণও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ হাজার ২০৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩২ শতাংশ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০