প্রতিনিধি, রাজশাহী: একসময় পদ্মার বুকে ছিল ধু-ধু বালুচর, যেখানে স্বপ্নের কোনো আলো ছিল না। সেখানে ছিল কেবল শূন্যতা, অন্ধকার আর নিরাশা। কিন্তু সময়ের স্রোতে, কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই পরিত্যক্ত বালুচর এখন সবুজের সমারোহে রূপান্তরিত হয়েছে। বালির প্রান্তরে এখন ঝরনার মতো ফসলের স্রোত, যা সিক্ত করছে কৃষকদের আশা ও আকাক্সক্ষা।
এখানে প্রতি শস্যে লুকিয়ে আছে তাদের সংগ্রামের কাহিনি বেগুন, আলু, পেঁয়াজের চাষে ফুটে উঠেছে নতুন জীবনের উল্লাস। কৃষকরা তাদের স্বপ্নকে বীজের সঙ্গে বপন করেছেন, প্রতিটি ফসল তাদের চেতনার অঙ্গীকার। পদ্মার বুকে এই বদলে যাওয়া চিত্র এখন শুধু কৃষকদের নয় বরং তাদের স্বপ্নের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কৃষকরা বলছেন, রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মার বালুচর একসময় ছিল তাদের জন্য অভিশাপ। নদীর ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পর, কৃষকেরা যখন হতাশায় ডুবেছিলেন, তখন তারা এই পরিত্যক্ত বালুচরকে নতুন করে চাষের উপযোগী করে তোলেন। আজ সেই বালুচর তাদের সাফল্যের কাহিনি লিখছে। এখানে এখন সবুজের সমারোহ, বেগুন, আলু, পেঁয়াজের মতো নানা শস্যের ফলন কৃষকদের জীবনে এনে দিয়েছে নতুন আশা। তারা বিশ্বাস করেন, এই ভূমি তাদের সংগ্রামের প্রতীক এবং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কৃষকেরা এখন এই বালুচরকে তাদের স্বপ্নের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
তারা বলছেন, পলি জমে উর্বর হয়ে ওঠা এই জমিতে এখন সারা বছর ফসল ফলানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে চকরাজাপুরের পরিবারগুলো নতুন আশা নিয়ে এই বালুচরে কাজ করছে এবং তাদের দৃষ্টান্ত অন্যান্য কৃষকদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।
নারী কৃষকদের অবদানও এখানে অপরিসীম। তারা সমানভাবে পুরুষদের সঙ্গে মাঠে কাজ করে, ফসলের উৎপাদনে সহায়তা করছেন। তাদের এই শ্রমের ফলে বালুচরগুলো সত্যিই ফসলের জমিতে পরিণত হয়েছে। নারীরা তাদের স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। চকরাজাপুরের একজন নারী কৃষক বলেন, ‘আমরা মাঠে কাজ করছি, কারণ আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি প্রয়োজন। আমরা আমাদের শ্রমের মাধ্যমে ফসল ফলাচ্ছি, যা আমাদের পরিবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ এই মৌসুমে অনেক কৃষক সফল হয়েছেন, যা নারী কৃষকদের অবদানের একটি প্রমাণ।
চরের সবজি চাষি রবিউল ইসলাম মোল্লা বলেন, বালুচরে ফসল ফলানো হবে এটা কখনো ভাবিনি। আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি যে, এই বালুচরে কিছু ফলানো যায় না। এখন আমি এই বালুচরে ফসল রোপণ করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছি। প্রতিবছরই চাষের জমির পরিধি বাড়ছে এবং ফলনও বাড়ছে।
একই এলাকার আফজাল হোসেন নানার আরও একজন কৃষক বলেন, বালুচরে চাষ শুরু করার আগে আমরা অনেকটাই হতাশ ছিলাম। কিন্তু আজকে এই জমিতে ফসল ফলিয়ে আমরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। এখন আমরা বেগুন, আলু এবং পেঁয়াজের চাষ করছি, যা আমাদের পরিবারের জীবনে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, যদি আমাদের আরও সহায়তা দেয়া হয়, তবে আমরা এই বালুচরকে আরও উর্বর করে তুলতে পারব। এটি আমাদের শ্রমের ফল।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, বালুচরে নতুন করে সবজি চাষের সফলতা দেখে আরও কৃষকরা এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন। প্রতি বছর নতুন নতুন কৃষকরা বালুচরে ফসল চাষ শুরু করছেন, এতে উৎপাদন বাড়াচ্ছে। সঠিক সহায়তা পেলে পদ্মার বালুচরের এই ফসলি জমিগুলো তাদের আর্থিক সচ্ছলতার মূল ভিত্তি হয়ে উঠবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লা সুলতান বলেন, ‘কয়েক বছর আগে যেখানে শুধুই বালুর চাঁই ছিল, সেখানে এখন বেগুন, আলু, পেঁয়াজ, মরিচসহ নানা ফসলের চাষ হচ্ছে। এটি সত্যিই একটি কৃষক সমাজের অধ্যবসায়ের ফসল। তারা যে সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও নিজেদের জীবনধারাকে পরিবর্তন করেছে, তা সত্যিই অনন্য।’ কৃষকদের অধ্যবসায়ের ফলেই এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বালুচরে ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, আলু, ধান, পাটসহ নানা ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে। আমি মনে করি, যদি এই কৃষকরা সরকারি সহায়তা পান, তবে তারা আরও বড় আকারে চাষ করতে সক্ষম হবেন। আমাদের সরকার তাদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে, যেমন- কৃষি প্রশিক্ষণ, বীজ ও সার সরবরাহ, যা তাদের উৎপাদনকে আরও বাড়াতে সাহায্য করবে।
তিনি বলেন, সরকারি সহায়তা পেলে কৃষকদের আর্থিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এবং তারা নিজেদের জীবনে নতুন দিগন্ত উšে§াচন করতে পারবেন।