বিদ্যুৎ খাতের নানা অনিয়ম নিয়ে সম্প্রতি বিশেষ অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। আজ থাকছে এর দ্বিতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলে ১০০ ও ৫২ মেগাওয়াটের তরল জ্বালানিভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ পায় সামিট পাওয়ার। তবে নিজেদের ইচ্ছেমতো পরে বদলে ফেলা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নির্মাণের স্থান। সৈয়দপুর ও শান্তাহারের পরিবর্তে বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নির্মাণ করে সামিট গ্রুপ। যদিও যথাসময়ে নির্মাণ না করলেও সামিটকে কোনো ধরনের জরিমানা করতে পারেনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তাদের ক্ষমতার কাছে হার মানতে হয় রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটিকে।
এমনই নানা ধরনের অবৈধ সুবিধা নিয়েছে বিদ্যুৎ খাতের মাফিয়া সামিট পাওয়ার ও তাদের ব্যবসায়িক সহযোগী আরেক প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে বিদ্যুৎ খাতের এমন বেশকিছু অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বিদ্যুৎ বিভাগ বা পিডিবির পরিকল্পনাও অনেক সময় বদলে যেত সামিট গ্রুপের চাপে। আর দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নয়, বরং নিজেদের ইচ্ছেমতো বিদ্যুৎ ব্যবসা পরিচালনা করত সামিট।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি শান্তাহার ৫২ মেগাওয়াট এবং সৈয়দপুর ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয় ২০১১ সালের ১ জুন। তেলভিক্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি যথাসময়ে নির্মাণে ব্যর্থ হলে কয়েক দফা তাগাদাপত্র দেয়া হয় সামিট গ্রুপকে। শেষ পর্যন্ত অগ্রগতি না হওয়ায় আইন অনুযায়ী সামিটের ১২ লাখ ডলার জামানত (পিজি) বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় পিডিবি। সে অনুযায়ী জামানত বাজেয়াপ্ত করার নোটিশও দেয়া হয়েছিল পিডিবির পক্ষ থেকে।
যদিও প্রভাবশালী সামিট গ্রুপের চাপের কারণে সবকিছু বদলে যায়। তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের নির্দেশে জামানত বাজেয়াপ্তের নোটিশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় পিডিবি। উল্টো সময় বাড়িয়ে শান্তাহার ও সৈয়দপুরের পরিবর্তে নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ ও বরিশালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয় সামিটের চাওয়া অনুযায়ী, যা বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে ছিল সরাসরি সাংঘর্ষিক।
সূত্র জানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি উত্তরাঞ্চলে নির্মাণে উদ্যোগ নেয়ার প্রধান লক্ষ্য ছিল ওই অঞ্চলে সান্ধ্যকালীন লোডশেডিং দূর করা। ওই সময়ে (২০১২ সাল) আশুগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনের কারণে একদিকে যেমন সিস্টেম লস হতো, তেমনি ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিল। এতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কঠিন ছিল। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি যুক্ত করা হয়েছিল মাস্টারপ্ল্যানে। তবে সামিটের কারণে তা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় পিডিবি। পরে চুক্তি দুটি সংশোধন করা হয়।
যদিও এর মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম তথা লিভারালাইজড ট্যারিফে বাড়তি সুবিধা পেয়ে যায় সামিট। কারণ সৈয়দপুর ও শান্তাহারে বিদ্যুৎকেন্দ্র তেল সরবরাহ করতে হলে চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে বাঘাবাড়ী, সেখান থেকে রেল অথবা সড়কপথে জ্বালানি সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু কেন্দ্র দুটি বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়ায় সামিটের জন্য তা ব্যয় সাশ্রয়ী হয়।
শুধু ওই দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই নয়, যোগ্যতা না থাকলেও বৃহৎ আরও দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বিবিয়ানা-১ ও ২ নির্মাণের কাজ পায় সামিট। ২০১১ সালের ১২ মে চুক্তির দুই বছরের মধ্যে কেন্দ্র দুটি উৎপাদনে আসার কথা ছিল। এর মধ্যে বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে তুলনামূলক কম ব্যয় ও ক্যাপাসিটি চার্জ প্রস্তাব করেছিল সামিট। পরে সেটি আর নির্মাণই করেনি কোম্পানিটি। নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে না পারায় চুক্তি বাতিল করলেও সামিটের ৩০ লাখ (তিন মিলিয়ন) ডলার জামানত (পিজি) বাজেয়াপ্ত করতে পারেনি পিডিবি। উইন উইন সিচুয়েশনের কথা বলে তারা জামানত ফেরত নিয়ে যায়।
অন্যদিকে সামিট বিবিয়ানা-২ কেন্দ্রটি ছিল ফার্নেস অয়েল ও গ্যাসচালিত দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক। তবে দুই বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মাত্র ১০ শতাংশ কাজ করে সামিট। তবে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বিশেষ ধরনের ফার্নেস অয়েল লাগে, যা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) আমদানি করে না যুক্তি দেখিয়ে চুক্তি বদলে ফেলে সামিট। এক্ষেত্রে তারা ডিজেল ও গ্যাসচালিত দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে। এর মাধ্যমে সামিট নির্মাণব্যয়ে বাড়তি সুবিধা পেলেও ডিজেলের বিদ্যুৎ কিনে পিডিবির বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা গেছে। উচ্চ উৎপাদন ব্যয়ের জন্য অনেক সময় এ কেন্দ্রটি বসিয়ে রেখে মাসের পর মাস ক্যাপাসিটি চার্জও গুনতে হয়েছে পিডিবিকে।
যদিও বিপিসির আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েলের মান ভালো নয় যুক্তি দেখিয়ে নানা রকম ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সরাসরি এ তেল আমদানির অনুমতি বাগিয়ে নিয়েছিল সামিট নিজেই। এক্ষেত্রে বছরে ১ লাখ টন তেল আমদানির জন্য সামিটকে ট্যাক্স অব্যাহতি দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, তেলের আমদানি ব্যয় মেটাতে উল্টো সরকারের পক্ষ থেকে সামিটকে আমদানি মূল্যের ওপর ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দেয়া হয়। এরপরও তারা নিজেরা বিশেষ ধরনের ফার্নেস অয়েল আমদানি না করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধরন বদলে ফেলেছিল।
এদিকে সামিটের আরেক ব্যবসায়ী সহযোগী ইউনাইটেড পাওয়ার গ্যাস ও বিদ্যুতের দামে ছলচাতুরি করে বড় অঙ্কের মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন (ইউপিজিডি) কোম্পানির ঢাকা ইপিজেড এলাকায় ৮৬ মেগাওয়াট ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত ৭২ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো রকম আইন মানা হয়নি। কেন্দ্র দুটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল তথা ইপিজেডের কাছে বিক্রি করা হয়।
এ কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটিকে ক্যাপটিভ বিবেচনায় গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই সময় আইপিপির (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) জন্য গ্যাসের দর নির্ধারণ করা হয় ১৬ টাকা। তবে ক্যাপটিভ হওয়ার পরও ইউনাটেড গ্রুপ ১৬ টাকায় গ্যাস পেতে তদবির শুরু করে। এ নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মধ্যে একাধিকবার চিঠি চালাচালি হয়। তবে বিইআরসি স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ইউনাইটেডের এ দুটি কেন্দ্র কোনোভাবেই আইপিপি হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। তাই ক্যাপটিভের দরেই তাদের গ্যাসের মূল্য দিতে হবে।
পরে ইউনাইটেড রিভিউয়ের আবেদন করলে তা নাকচ হয়ে যায়। বিইআরসিতে হেরে আদালতের দ্বারস্থ হয় সরকারের ঘনিষ্ঠ ইউনাইটেড গ্রুপ। সেখানেও হেরে যায় তারা। পরে আপিল বিভাগেও তারা হারে। যদিও পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি দিয়ে বিশেষ তদবিরের মাধ্যমে আইপিপির দরে গ্যাসের দাম রাখার সুযোগ আদায় করে নেয় ইউনাইটেড।
যদিও এখানেই কোম্পানিটির মুনাফার শেষ নয়। ইপিজেডে উচ্চ দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে তারা দ্বিগুণ মুনাফা করছে। এ প্রসঙ্গে পিডিবির কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে জানান, ইউনাইটেড পাওয়ার ইপিজেডে বিদ্যুৎ বিক্রির দাম নিজেরাই নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে পিডিবির বিদ্যুৎ বিক্রির গড় দামের সমান দাম তারা ইপিজেড থেকে আদায় করে। গত অর্থবছর পিডিবির বিদ্যুৎ বিক্রির গড় দাম ছিল প্রায় ১১ টাকা। এর মধ্যে গ্যাস, তেল, কয়লা, আমদানিসহ সব ধরনের বিদ্যুতের দাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তারা আরও জানান, শুধু গ্যাসের কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গত অর্থবছর ব্যয় ছিল ছয় টাকারও কম। তবে ইউনাইটেড পাওয়ার কম দামে গ্যাস কিনেও পিডিবির গড় দামের সমান অর্থাৎ ১১ টাকায় ইপিজেডের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করেছে। যদিও পিডিবির কাছে তারা বিদ্যুৎ বিক্রি করলে ছয় টাকার কম দামই পায়। ইপিজেডের সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় তারা পিডিবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। এ হিসাবে ছয় টাকার বিদ্যুৎ ১১ টাকায় বিক্রি করে ইউনাইটেড গত অর্থবছর কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছে।