আবদুর রহিম, নারায়ণগঞ্জ: বন্যা ও বর্ষা মৌসুমের বদান্যতায় পানি বেড়েছে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গায়। কেটেছে দূষণের মাত্রাও। নদীর স্বচ্ছ পানিতে জলকেলিতে মত্ত হতে দেখা যায় শিশু-কিশোরদের। বছরের এই সময়টিতে নদী দুটি তাদের যৌবন ফিরে পেলেও শুষ্ক মৌসুমে তা যেন প্রাণ হারায়।
মূলত শীতে পানি কমে এলে ডাইং কারখানার দূষিত তরল বর্জ্যরে আধিক্য বেড়ে যায় নদীতে। ওই মৌসুমে নদী রক্ষায় বিভিন্ন মহল থেকে ভেসে আসে ‘দরদের ঢেউ’। তবে দূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজও। বেশ কয়েক বছর আগে শীতলক্ষ্যা রক্ষায় সেন্ট্রাল ইটিপি প্লান্টের কথা জানিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। মাঠপর্যায়ে সমীক্ষা চালানো হলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে সেন্ট্রাল ইটিপির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি নিজের একটি পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘২০০২ সালে দেশের বাইরে থেকে একটি টিম এসেছিল। তারা দেখতে চেয়েছিল, পরিবেশ রক্ষার্থে কোথায় ইটিপি (ইফল্যুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) করা যায়। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল, ওই টিমকে যেন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় ভিজিট করাই। আমি তাদের নিয়ে ভিজিট করলাম। সেখানে বলা হলো, একটি খালের দুই মাথায় যদি সেন্ট্রাল ইটিপি করা যায়, তাহলে পানিটা পরিশোধন হয়ে তারপর নদীতে যাবে এবং নদী দূষণমুক্ত থাকবে। সেখানে প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রি থেকে মাসিক হারে বিল আদায় করা হবে, যেভাবে আমরা বিদ্যুৎ বিল প্রদান করি।
এটাকে কঠোরভাবে সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই কার্যক্রমটা আর এগোয়নি।’
নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের বেস্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে সেন্ট্রাল ইটিপি নিয়ে স্টাডি হলেও এই উদ্যোগ বন্ধ রয়েছে। তবে নদী রক্ষায় তারা ইটিপি ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে কাজ করে গেলেও কারখানা মালিকদের সদিচ্ছার অভাব ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ তুলছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ‘ইটিপির সঠিক ব্যবহার না করাটা দুঃখনজক হলেও এতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়ও রয়েছে। কেননা, বর্জ্য পরিশোধনকরণ কেমিক্যালে সরকার প্রায় ৫০ শতাংশ কর নিয়ে থাকে। এতে ব্যয় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না মালিকরা। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে সেন্ট্রাল ইটিপি করার আহ্বান জানানো হলেও তা আশ্বাসেই আটকে আছে। ফলে দূষণ রোধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য নিয়ে আমি বহুবার কথা বলেছি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা খুব কঠিন মানুষ। তিনি পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।’ হাতেম বলেন, ‘সাংবাদিকদের উচিত এই বিষয়টি স্প্যাসিফিকভাবে তুলে ধরা। দেখুন, আমার ইন্ডাস্ট্রিতে ইটিপি রয়েছে। আমি টাকা খরচ করে ইটিপি নির্মাণ এবং তা ব্যবহার করে বর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে খালে পানি ছাড়লাম, কিন্তু আরও ২০০ কারখানা ইটিপি ব্যবহার ছাড়াই খালে কেমিক্যালযুক্ত দূষিত বর্জ্য ফেলে যাচ্ছে। তো আমি যে ইটিপি ব্যবহার করলাম, এটাতে কোনো লাভ হলো না। খাল হয়ে নদীতে তো দূষিত পানিটাই যাচ্ছে। আমি বলব, কেউ যেন এভাবে পরিবেশ দূষণ করতে না পারে। এ বিষয়ে আমরা পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানাই।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জে এখন পর্যন্ত ৩৪৬টি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি নির্মাণ করা হয়েছে। আর ১১৪টি প্রতিষ্ঠান এখনও ইটিপি নির্মাণ করেনি। ওই ১১৪টির মধ্যে ১০টি কারখানা বন্ধ রয়েছে।
অধিদপ্তরটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ইফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) বা বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনা নির্মাণ করলেও নদীগুলো দূষণমুক্ত হয়নি। এর প্রধান কারণ হলো, শিল্পমালিকরা ইটিপি নির্মাণ করলেও তা নিয়মিত ব্যবহার করেন না। অভিযান ঠেকাতে মালিকরা লোকদেখানো ইটিপি নির্মাণ করে রেখেছেন। ফলে ইটিপি থাকলেও বিষাক্ত তরল বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই ড্রেন ও খালের মাধ্যমে তা নদীতে ফেলে যাচ্ছেন শিল্পমালিকরা।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘এটা নিয়ে শিল্পমালিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে কথা বলতে হবে। সবার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে হবে। তারপর করণীয় সম্পর্কে উদ্যোগ নিতে হবে।