নিজস্ব প্রতিবেদক: তারল্য সংকট মোকাবিলায় আন্তঃব্যাংক থেকে আরও দেড় হাজার কোটি টাকার বিশেষ ধার পেয়েছে দুর্বল ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো হলোÑইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৮০০ কোটি টাকার ধার পেয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে তিনটি সবল ব্যাংক তাদের এই ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকই দিয়েছে প্রায় এক হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। বাকি ১০০ কোটি টাকা দিয়েছে ইস্টার্ন ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৪২৫ কোটি টাকার ধার পেল ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তঃব্যাংক থেকে এই সহায়তা পাওয়ায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এখন আমানতের টাকা তুলতে গিয়ে কাউকে হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে না। যদিও এখনও চাহিদা অনুযায়ী আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হোসনে আরা শিখা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা প্রদানে গ্যারান্টি প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে সবল ব্যাংকগুলো থেকে তারা তারল্য সহায়তা পাচ্ছে, যার একটা ইতিবাচক প্রভাব পুরো খাতে পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে যে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে, সেগুলোর ক্যাশ-ফ্লো ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, গ্রাহকের চাহিদা মেটানোর পরও ওই ব্যাংকগুলোতে দিনশেষে উদ্বৃত্ত তারল্য থাকছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলোর ওপর গ্রাহকরা আস্থা ফিরে পাচ্ছেন।
জানা যায়, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে যেসব ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাদের সংকট কাটাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি সাক্ষেপে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে ভালো ১০টি ব্যাংক ঋণ সহায়তা দিতে রাজি হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরে সঙ্গে এক বৈঠকে এসব ব্যাংকের এমডিরা তাদের তারল্য সহায়তা দেয়ার বিষয়ে সম্মতি প্রকাশ করেন। এর অংশ হিসেবে প্রথম দফায় চারটি দুর্বল ব্যাংককে ৯৭৫ কোটি টাকার ধার দেয় পাঁচটি সবল ব্যাংক। এখন দ্বিতীয় দফায় আগের চারটিসহ পাঁচটি ব্যাংকে আরও এক হাজার ৪৮০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে তিনটি সবল ব্যাংক।
সূত্র জানায়, এই এক হাজার ৪৮০ কোটি টাকার মধ্যে ৮০০ কোটি টাকার ধার পেয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৭০০ কোটি টাকাই দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। আর ৫০ কোটি টাকা করে দিয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। এছাড়া দ্বিতীয় দফায় স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক ২৫০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ২৩০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ১২৫ কোটি টাকা ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭৫ কোটি টাকার টাকার ধার পেয়েছে। এই ব্যাংকগুলোও সোনালী ব্যাংক থেকে এই অর্থ ধার পেয়েছে।
এর আগে গত ২ অক্টোবর প্রথম দফায় আন্তঃব্যাংক থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক ৯৪৫ কোটি টাকার বিশেষ ধার পায়। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে ৩০০ কোটি টাকার ধার দেয় দ্য সিটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার ধার পায় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। ইসলামী দ্য সিটি ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে এই ধার পায় ব্যাংকটি। ন্যাশনাল ব্যাংক পায় ২৭০ কোটি টাকার ধার। ব্যাংকটিকে এই ঋণ দেয় দ্য সিটি ব্যাংক, মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক। আর গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ধার পায় ২৫ কোটি টাকা। এই ঋণের পুরোটাই দেয় ইস্টার্ন ব্যাংক।
এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল, আমানত প্লেসমেন্ট হিসেবে দুর্বল ব্যাংককে নির্ধারিত মেয়াদে বিশেষ ধার দেবে ভালো ব্যাংক। সবল ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া ঋণের এই টাকা দুর্বল ব্যাংকগুলো দিতে ব্যর্থ হলে সেই টাকা মেয়াদোত্তীর্ণের তিন দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত দেবে।
তবে ধারের অর্থ ব্যবহারে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ১০টি শর্ত দেয়া হয়। এর মধ্যে আছেÑএই অর্থ দিয়ে ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান পরিচালকদের নামে-বেনামে রাখা আমানত পরিশোধ করা যাবে না। একই সঙ্গে তাদের অনুকূলে কোনো ঋণ দেয়া যাবে না। পাশাপাশি গ্যারান্টির বিপরীতে কোনো দায় অপরিশোধিত থাকলে নগদ লভ্যাংশও দেয়া যাবে না। এছাড়া গ্যারান্টির অর্থে নতুন কোনো ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগ করা যাবে না। বিদ্যমান ঋণও বর্ধিত করা যাবে না। আগের কোনো ঋণ অনুমোদন হয়েছে, তবে তা ছাড় করা হয়নি, এমন ঋণও বিতরণ করা যাবে না। এই অর্থ দিয়ে ব্যাংকের বিদ্যমান কোনো আন্তঃব্যাংক দায় বা প্লেসমেন্টের অর্থ পরিশোধ করা যাবে না। ফোর্সড ঋণ বা এলটিআর সৃস্টির মাধ্যমে এলসি দায় পরিশোধের লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করা যাবে না। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করা যাবে না।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে এগুলোসহ মোট ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নামে-বেনামে টাকা বের করে নেয়ায় তীব্র তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে ব্যাংকগুলোয়। দীর্ঘদিন ধরে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবেও ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। তবে হিসাব ঋণাত্মক হলেও লেনদেন অব্যাহত রাখার সুযোগ দিয়েছিলেন সাবেক পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। টাকা ছাপিয়ে দেয়া সেই বিশেষ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।