২০২৩-২৪ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়েছে ৫৪%

ইসমাইল আলী: চাহিদা বিবেচনা না করে গত এক দশক ধরে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এতে সরকারি, বেসরকারি ও আমদানি মিলিয়ে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। যদিও সক্ষমতার অর্ধেকও উৎপাদন করা হচ্ছে না। ডলার সংকটে জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় এসব কেন্দ্র বছরের বেশিরভাগ সময় বসে থাকে। ফলে বসিয়ে রেখেই মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর এ খাতে রেকর্ড ৫৪ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দকৃত ভর্তুকির বড় অংশই চলে যাচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের বরাদ্দকৃত ভর্তুকির সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না। একদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে পিডিবির লোকসানও বেড়েই চলেছে।

পিডিবির গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত অর্থবছর সক্ষমতার ব্যবহার হয়েছে মাত্র ৩৬ শতাংশ, যা দেড় দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। বর্তমানে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৩৬৯ মেগাওয়াট। আদানি, এসএস পাওয়ারসহ বড় বিভিন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করায় সক্ষমতা বেড়ে গেছে। এছাড়া সামিট, ইউনিকসহ বেশকিছু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস তথা এলএনজিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্থবছরের শেষ দিকে উৎপাদন শুরু করে। এসব কেন্দ্রের কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়।

২০২৩-২৪ অর্থবছর বেসরকারি আইপিপির (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫টি। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলচালিত ৪৩টি, কয়লাভিত্তিক চারটি, ডিজেলচালিত একটি ও গ্যাসচালিত ১৭টি কেন্দ্র রয়েছে। আর রেন্টাল কেন্দ্র ছিল ৯টি, যার মধ্যে ছয়টি ফার্নেস অয়েল ও তিনটি গ্যাসচালিত। এছাড়া আদানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এসব কেন্দ্র গত অর্থবছর মাত্র ৩৬ শতাংশ চলেছে। তবে কেন্দ্রগুলোর পুরো সক্ষমতার জন্যই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। এতে খাতটিতে ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৪৬৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১২ হাজার ৪১৫ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর উৎপাদন সক্ষমতার ৪২ শতাংশ ব্যবহার হয়। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়েছে ৯ হাজার ৬৭৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা বা ৫৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। যদিও এ সময় উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে তিন হাজার ৯৫৪ মেগাওয়াট বা ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

পিডিবির কর্মকর্তা বলছেন, ক্যাপাসিটি চার্জ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনের মূলত দুটি কারণ রয়েছে। চাহিদা না থাকলেও একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসায় সক্ষমতা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ডলারের বিনিময় হার দরে। ডলারের বিনিময় হার গত অর্থবছর প্রায় সাড়ে আট শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণেও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে গেছে। এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছর রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১০ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছিল, যার বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ১৩ হাজার ৭০০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ে এক হাজার ৬৫৫ মেগাওয়াট বা ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বাড়ে চার হাজার ৮৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বা ২৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৯ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর সক্ষমতার ৪৬ শতাংশ ব্যবহার হয়েছিল। আর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছিল ১৩ হাজার ২১ কোটি তিন লাখ টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল আট হাজার ৪১১ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ৩৯ শতাংশ ব্যবহার হয়। তবে ভর্তুকি দিতে হয়েছিল ১০ হাজার ৮৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে গত পাঁচ অর্থবছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৮২ হাজার ৮২৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। যদিও এ সময় বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভর্তুকির ৬৭ শতাংশ অর্থ গেছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। আর গত অর্থবছর সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েছে ৩৮ হাজার ২৮৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধেই গেছে ভর্তুকির ৭১ দশমিক ৭৩ শতাংশ অর্থ।

এর আগের (২০২২-২৩) অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছর ২৯ হাজার ৬৫৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছর ১১ হাজার ৭৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা ও ২০১৯-২০ অর্থবছর সাত হাজার ৪৩৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অন্যদিকে গত পাঁচ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনেছে এক লাখ ৫০ হাজার ৫৫২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছর লোকসান ছিল মাত্র সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছর ৩২ হাজার ৮৯১ কোটি ১৭ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫১ হাজার ৩০০ কোটি ৪৫ লাখ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর (অনিরীক্ষিত হিসাবে) ৪৭ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০