নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি অর্থবছর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ ও শিল্পে প্রবৃদ্ধি দুর্বল অবস্থায় পৌঁছাবে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক বন্যার ফলে কৃষিতে মাঝারি মানের প্রবৃদ্ধি হবে বলে মনে করছে উন্নয়ন সহযোগী এ প্রতিষ্ঠানটি। তবে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক আগে সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিয়েছিল, সংস্থাটি বলছে সে প্রবৃদ্ধি তার চেয়েও বেশি হবে।
গত বুধবার মধ্যরাতে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট: উইমেন, জবস অ্যান্ড গ্রোথ’ শীর্ষক প্রকাশনায় এ ধরনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। প্রতি বছর এপ্রিল ও অক্টোবরে দুবার দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা প্রকাশ করে সংস্থাটি। এর আগে এপ্রিল সংস্করণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অক্টোবর সংস্করণে পূর্বাভাস কমিয়ে আনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে থাকবে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, মধ্যবর্তী পয়েন্ট হবে ৪ শতাংশ। এর আগে এপ্রিলে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বিশ্বব্যাংক ৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এক দশমিক ৭ শতাংশ হ্রাস করেছে সংস্থাটি, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ হার।
অক্টোবর সংস্করণে বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি দেশ (মালদ্বীপ) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস করেছে। বাকি পাঁচটি দেশের জন্য পূর্বাভাস বাড়ানো হয়েছে। সংস্থা বলছে, চলতি অর্থবছর মালদ্বীপের প্রবৃদ্ধি হতে পারে চার দশমিক ৭ শতাংশ, যা এপ্রিলের পূর্বাভাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কম। এছাড়া ভারতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৭ শতাংশ, যা আগের ঘোষিত পূর্বাভাসের চেয়ে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
পাকিস্তান ও নেপালের প্রবৃদ্ধি আগের পূর্বাভাসের চেয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন হিসাবে এ দুই দেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে যথাক্রমে দুই দশমিক ৮ ও পাঁচ দশমিক ১ শতাংশ। আর শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি আগের পূর্বাভাসের চেয়ে এক শতাংশ বেড়ে সাড়ে তিন শতাংশ দাঁড়াতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় চলতি অর্থবছর সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হতে পারে ভুটানে। নতুন পূর্বাভাস অনুযায়ী দেশটির প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়াতে পারে সাত দশমিক ২ শতাংশ, যা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে দেড় শতাংশ বেশি।
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে আওয়ামী লীগ সরকার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সেই হিসেবে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস সরকারি লক্ষ্যের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী কমে গেলে তা হবে কভিড মহামারির পর সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি। ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি থাকায় ওই সময় দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থকায় ও পরবর্তী সময়ে সীমিত আকারে কার্যক্রম শুরু হওয়ায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
চলতি অর্থবছরের পূর্বাভাস কমানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক গত (২০২৩-২৪) অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলিত হিসাবও কমিয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়েছে। গত অর্থবছরের জন্য সরকারের সাময়িক প্রাক্কলন ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ করেছে। তবে এখনও চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এরপরই রয়েছে পাকিস্তান, যাদের মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ৯ শতাংশ। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাদ্য মূল্যস্ফীতিও বাংলাদেশে। যদিও পাকিস্তানে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেশি। অন্য দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এক শতাংশের কাছাকাছি। এছাড়া মালদ্বীপে মূল্যস্ফীতি এক শতাংশের কিছুটা বেশি আর ভুটানে প্রায় দেড় শতাংশ।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান না থাকা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আভাসকে ঘিরে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তাদের পূর্বাভাস তাকেই প্রতিফলিত করছে। স্বল্প মেয়াদে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। অন্যদিকে বন্যার কারণে কৃষি উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে মধ্য থেকে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছে বিশ্বব্যাংক। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, এর ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে মনে করে সংস্থাটি। এ ক্ষেত্রে আর্থিক খাতে সংস্কার, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব বাড়ানোর পদক্ষেপ, ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি ও বাণিজ্য চাঙা হওয়ার বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক।
সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, চলতি অর্থবছর এই অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা তাদের আগে করা পূর্বাভাসের চেয়ে সামান্য (০.১%) বেশি। এর ফলে এ অঞ্চল অর্থনীতির দিকে থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চলে পরিণত হওয়ার ধারা বজায় রাখবে। বাংলাদেশের ক্রমহ্রাসমান রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের পর গত জুনে বাংলাদেশের গ্রস রিজার্ভ (বিপিএম-৬) দিয়ে মাত্র তিন দশমিক তিন মাসের আমদানি চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল। এছাড়া নেপাল ও পাকিস্তানের রিজার্ভও কমছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
এদিকে নারীদের যদি আরও বেশি সংখ্যায় কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসা যায় এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও উদারীকরণ করা হলে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদার হবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলো তাদের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে।
দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইসার বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে প্রতিশ্রুতিশীল, তবে এ অঞ্চলটি তার পূর্ণ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে আরও অনেক কিছু করতে পারে। আরও বেশি নারীকে কর্মশক্তিতে একীভূত করতে হবে। পাশাপাশি বৈশ্বিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। প্রয়োজনে মূলনীতি সংস্কার করতে হবে। তাহলে প্রবৃদ্ধিকে আরও এগিয়ে নেয়া যাবে। আমাদের গবেষণা দেখায়, এ অঞ্চলে পুরুষদের তুলনায় নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার আঞ্চলিক জিডিপি ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।’
সংস্থাটি আরও জানায়, দক্ষিণ এশিয়ায় নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২৩ সালে মাত্র ৩২ শতাংশ কর্মজীবী নারী শ্রমশক্তিতে ছিলেন, যেখানে এই অঞ্চলের ৭৭ শতাংশ কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কম। ভুটান ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ২০২৩ সালে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার একই স্তরের উন্নয়নের দেশগুলোর তুলনায় ৫ থেকে ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কম ছিল। নারী শ্রমশক্তিতে এ ঘাটতি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বিয়ের পর। গড়ে একবার বিবাহ দক্ষিণ এশিয়ার নারী শ্রমশক্তিকে কর্মে অংশগ্রহণ ১২ শতাংশ কমিয়ে দেয় তাদের সন্তান হওয়ার আগেই।