নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: দেশের অপরিশোধিত তেল ও চিনির বাজারে আধিপত্য সিটি, মেঘনা, এস আলম, টিকে গ্রুপ, বসুন্ধরা, আবদুল মোনেম ও দেশবন্ধুর, যারা পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারজাত করে। কিন্তু এ কয়েকজন ব্যবসায়ী হাতে নিয়ন্ত্রণ দেশের তেল ও চিনির বাজার। তাদের জন্য নতুন করে কেউ আমদানির সুযোগও পায় না। অথচ পরিশোধিত তেল ও চিনি আমদানির সুযোগ দিলে সহজে বাজার প্রতিযোগিতা সৃষ্টি ও দামের ভারসাম্য থাকত বলে মনে করেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও আমদানিকারক সূত্রে জানা যায়, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মুক্ত থাকে আমদানি ও রপ্তানি। আর গত সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত কয়েকজন ব্যবসায়ী আমদানির সুযোগ পেয়েছিল। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দেশে মোট সয়াবিন আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৮৩ হাজার ৪৫১ মেট্রিক টন, যার আমদানি মূল্য ছিল ১২ হাজার ১৩২ কোটি ৪১ লাখ টাকা। আর সরকারের শুল্ক আয় হয়েছিল এক হাজার ৬৬৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ তেল আমদানির ব্যয় ছিল ১৩ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ আমদানিকারক টিকে গ্রুপের আমদানি ছিল তিন লাখ ৫২ হাজার ২৬৫ মেট্রিক টন। এরপর বাংলাদেশ এডিবল অয়েল আমদানি করেছে এক লাখ ৮৯ হাজার ১৯২ মেট্রিক টন, সিটি গ্রুপ এক লাখ ৬৮ হাজার ২৬২ মেট্রিক টন, বসুন্ধরা গ্রুপ এক লাখ ৬২ হাজার ২৩৭ মেট্রিক টন, এস আলম গ্রুপ ৮৩ হাজার ২৫৪ মেট্রিক টন, মেঘনা গ্রুপ ৫৩ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন এবং আবুল খায়ের গ্রুপের স্মাইল ফুড ৫৭ হাজার ৮৭৯ মেট্রিক টন আমদানি করে। অপরদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দেশে মোট অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ৫০ হাজার ১১৯ মেট্রিক টন।
এর মধ্যে শীর্ষ আমদানিকারক মেঘনা গ্রুপ ছয় লাখ ২৪ হাজার ৪৮৭ মেট্রিক টন, সিটি গ্রুপ পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯১ মেট্রিক টন, এস আলম গ্রুপ তিন লাখ ৩৩ হাজার ১০০ মেট্রিক টন এবং আবদুল মোমেন গ্রুপ এক লাখ ৪৪ হাজার ২৮৯ মেট্রিক টন এবং দেশবন্ধু গ্রুপ এক লাখ আট হাজার ৩৮৪ মেট্রিক টন করেছিল। এসব ব্যবসায়ী তেল ও চিনির বাজারের নিয়ন্ত্রণ করছে। পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, চিনির বাজার আমাদের দেশে যখন ১২০ থেকে ১৩০ টাকা (ভারতে) পার্শ্ববর্তী দেশে চিনির খুচরা মূল্য ৪০ টাকা এবং পাইকারি মূল্য ৩৫ টাকা। সরকার যদি সাধারণ ব্যবসায়ীদের ফিনিশড গুডস আমদানি করার পারমিশন দেয়, কালকেই চিনির বাজার বাংলাদেশে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে চলে আসবে। এভাবে সব পণ্যেরই ফিনিশড গুডস আমদানি করার পারমিশন দিতে হবে। পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশজ উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরাসরি কৃষকদের উচ্চ মানের বীজ সরবরাহ এবং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে করপোরেট সন্ত্রাসীরা এভাবেই সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে ডাকাতি করতে থাকবে।
অর্থনীতিবিদ ও বাজারসংশ্লিষ্টরা বলেন, মনোপলি অর্থনীতি ভেঙে দিতে হবে। এতে করপোরেটদের সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। আর করপোরেট সিন্ডিকেট ভাঙার অন্যতম পন্থা হচ্ছে প্রত্যেকটা ভোগ্যপণ্য বাজার নিয়ন্ত্রিত করবে সাধারণ ব্যবসায়ীরা। করপোরেটদের হাতে ভোগ্যপণ্যের বাজার থাকা মানে দেশের অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক। প্রয়োজনবোধে আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের নীতি অবলম্বন করতে হবে, যেখানে এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাতেও কোনো প্রকার ভোগ্যপণ্য উৎপাদন হয় না। মধ্যপ্রাচ্যের সম্পূর্ণ অর্থনীতি হচ্ছে আমদানিনির্ভর। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে ভোগ্যপণ্যের বাজার সবসময় থাকে স্থিতিশীল। একজন ব্যক্তি অথবা একক করপোরেট গ্রুপ একাই ৫০ লাখ টন ভোগ্য পণ্য আমদানি করার চেয়েও ৫০০ সাধারণ ব্যবসায়ী ১০ লাখ টন পণ্য আমদানি করা শ্রেয়। কারণ বাজারে তখন থাকে প্রতিযোগিতা আর একক ব্যক্তি বা গুটিকয়েক ব্যক্তি যখন ভোগ্যপণ্যেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তখন বাজার থাকে সিন্ডিকেটের হাতে, কোনো প্রকার প্রতিযোগিতা থাকে না। যেমন চিনিশিল্পের ক্ষেত্রে আমাদের নিজের দেশের দেশীয় চিনিশিল্পকে নষ্ট করে ধ্বংস করে গুটিকয়েক সিন্ডিকেট করপোরেট গ্রুপ। চিনিশিল্পকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে সব সময় চিনিশিল্পে একটি অস্থিরতার মধ্যে রাখে। এখনই সময় দেশীয় চিনিশিল্পের উন্নয়ন।
দেশীয় চিনিশিল্পের উন্নয়ন মানে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন। এক্ষেত্রে প্রান্তিক কৃষকেরা লাভবান হবে, সাধারণ ব্যবসায়ীদেরও ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি হবে এবং দেশের ভোক্তাসাধারণ কম মূল্যে ভালো মানের চিনি খেতে পারবে। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে প্রথমত বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ফিনিশ গুডস আমদানির পারমিশন সাধারণ ব্যবসায়ীদের দিতে হবে। একইভাবে বিদেশ থেকে বোতলজাত ভোজ্যতেল আমদানির পন্থা সহজ করতে হবে। আর দ্বিতীয়টি হলো আমাদের দেশে প্রান্তিক কৃষকদের ভালো মানের সয়াবিন বীজ সরবরাহ করতে হবে এবং সরষের তেলের মিলের মতোই পুরো বাংলাদেশের জেলায় জেলায় যেন সয়াবিন তেলের ছোটখাটো ও মাঝারি মানের সয়াবিন তেলের মিল গড়ে তুলতে হবে। আর সাধারণ ব্যবসায়ীরা কারখানা করতে পারার মতো ব্যাংক লোনের সহজীকরণ করে দিতে হবে।
এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী সৈয়দ সাব্বির আহমেদ বলেন, করপোরেট মাফিয়াদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে দেশের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা সাধারণ ব্যবসায়ীদের জন্য উš§ুক্ত করে দিতে হবে। দেশের হাতেগোনা কয়েকটি শিল্প গ্রুপ নিত্যপণ্যের বাজারে ডাকাতি করছে। কিন্তু সরকার যদি দেশের সাধারণ ব্যবসায়ীদের নিত্যপণ্যের ফিনিশড গুডসের আমদানির পারমিশন দেয়, বিশেষ করে চিনি ও ভোজ্যতেল আমদানি করার পারমিশন দিলে করপোরেট সন্ত্রাসীরা আর ডাকাতি করতে পারবে না। ভোগ্যপণ্যেও দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য অতিসত্বর প্রত্যেকটা ভোগ্যপণ্যের ফিনিশড গুডস আমদানি করার পারমিশন সাধারণ ব্যবসায়ীদের দিতে হবে এবং দেশীয় কৃষিশিল্পের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
অপরদিকে এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলম বলেন, পুঁিজর অভাবে অনেকগুলো শিল্পকারখানা উৎপাদনের সুযোগ পাচ্ছে না। গত কয়েক দিনে পাইকারি বাজারের খোলা তেল ও চিনির দাম অনেক দাম বেড়েছে। এখন যদি আমাদের কাজে লাগানো হয়, কিংবা সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে আগামী দুমাসে কমপক্ষে ২০০ কারখানা চালু করা যাবে। এতে ভোগ্যপণ্যের বাজার ঠিক থাকবে, পাশাপাশি সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাবে। পাশাপাশি কয়েক লাখ বেকার লোকের কর্মসংস্থান হবে।