ঢাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীরা স্বৈরাচারমুক্ত হয়ে সন্ত্রাসে যুক্ত!

মোহাম্মদ আবু নোমান: শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করতে হবে? আগের সরকার যাদের ধরেছে, এখন তাদের মুক্তি! তারা তো স্বীকৃত কিলার ও সন্ত্রাসী, তাদের কোন বিবেচনায় ছাড়া হলো? এর দায়ভার কে নেবে? তাদের ছেড়ে রাখলে দেশের আইনশৃঙ্খলা তো বনবাসে চলে যাবে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর দেশের সর্বসাধারণ রাষ্ট্র গঠন ও পরিবর্তনের আশা করেছিল। আর এখন আমরা দেখছি ১০-২০ খুনের আসামি, যাদের বিরুদ্ধে এখনও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে, তারা জামিনে মুক্ত। এটাই কি আমাদের রাষ্ট্র গঠন ও পরিবর্তনের আশার আউটকাম পরিণতি? তাহলে কি এক জালিম গ্রুপের পতন, আরেক জালিম গ্রুপের আগমন ঘটবে? ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে একদল স্বৈরশাসকের পতন/পলায়ন ঘটেছে, যা সামান্য ব্যাপার নয়। স্বৈরশাসকরা গেলেও স্বৈরশাসনের ব্যবস্থাপনা কিন্তু পালায়নি। আমলাতন্ত্র ঠিকই রয়ে গেছে, যদিও শুধু বড় রকমের একটু ধাক্কা খেয়েছে মাত্র।
নতুন খবর হলো, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন পেয়ে আবারও সংগঠিত হচ্ছে এবং এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। এরই মধ্যে কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু করেছে। একইভাবে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ এরই মধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে। অপরাধের পুরোনো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দেয়ার পাশাপাশি চাঁদা চেয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকায় গত মাসে জোড়া খুনের একটি ঘটনায়ও এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম এসেছে।

নব্বইয়ের দশকে ঢাকার অপরাধজগতের আলোচিত নাম ছিল সুব্রত বাইন। আধিপত্য বিস্তার করে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিতে তার নাম আসা ছিল তখনকার নিয়মিত ঘটনা। এসব কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য খুন-জখমের ঘটনাও ঘটিয়েছে সুব্রত। ঢাকার একসময়কার সেই ত্রাস শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎ দলবল নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গেছে মগবাজারের বিশাল সেন্টারে। একটি দোকান দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে গিয়েছিল সে। এ নিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা আশঙ্কা করছেন, সুব্রত বাইনের পুরোনো চাঁদাবাজি আবারও শুরু হতে পারে।

সুব্রত বাইন, ‘বিশালের সুব্রত’ নামেও পরিচিত। মূলত তার অপরাধ সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে মগবাজারের বিশাল সেন্টারকে কেন্দ্র করে। এ সেন্টারের কাছাকাছি চাংপাই নামে এক রেস্টুরেন্টের কর্মচারী হিসেবে সু্ব্রতর জীবন শুরু হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকার অপরাধজগতের এক পরিচিত মুখে পরিণত হন। একসময় প্রতি বর্গফুট জায়গার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দুই টাকা চাঁদা আদায় করা ছিল তার নিয়মিত কাজ। ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুব্রত বাইন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়।
শুধু সুব্রত বাইন নয়, মোহাম্মদপুরে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালসহ অনেকেরই এ ধরনের তৎপরতা দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রায় দুই যুগ পর জামিনে বের হওয়া পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে। এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে সাদেক খান আড়তের সামনে ওই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। পুলিশ বলছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকার দখল নিতে সন্ত্রাসীদের দুই পক্ষের বিরোধ থেকে জোড়া খুনের ওই ঘটনা ঘটেছে।

আমরা বলতে চাই, এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর জামিনের জন্য যারা কলকাঠি নেড়েছে, যে কোর্ট জামিন দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে একটি প্রশ্নবিদ্ধ কাজের দৃষ্টান্ত তৈরি হলো। আমরা আশা করি তারা অবশ্যই এটার ব্যাখ্যা দেবেন। যারা মোস্ট ওয়ান্টেডকে ছেড়ে দিয়েছে, তারা ব্যাখ্যা কী দেবেন, কতটুকু দেবেন আন্দাজ করা যায়। কিন্তু টালবাহানার বা হেনতেন অপব্যাখ্যা শান্তিপ্রিয় জনগণ শুনতে চায় না। ১০-২০ খুনের আসামি ও দাগি সন্ত্রাসীরা আইনের কোন ধারায় মুক্তি পেল, এটা জানার অধিকার জনগণের অবশ্যই রয়েছে। আমরা যতটুকু বুঝি, ১০টা হত্যা মামলার আসামির তো দশবার ফাঁসি হওয়ার কথা, যেখানে তাদের মতো অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কথা, সেখানে সে ছাড় পেল কোন বিচার ও যুক্তিতে? আওয়ামী সরকারের পতনের পর রাধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় তৎপরতা বেড়েছে সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়া আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের। মোহাম্মদপুরের অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার বাদলও এখন সক্রিয়, যে কারণে পিচ্চি হেলাল ও কিলার বাদলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের কয়েকটি সংঘাত-সহিংসতার পেছনে দুপক্ষের দ্বন্দ্বই প্রধান কারণ বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে।

একইভাবে রাজধানীর মিরপুর, পল্লবী ও কাফরুল এলাকায় অন্তত ছয় সন্ত্রাসী বিভিন্নভাবে সক্রিয়। এর মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান ওরফে মামুন সবেচেয়ে বেশি তৎপর বলে গণমাধ্যমে এসেছে। তার বিরুদ্ধে অন্তত ২৭টি মামলা রয়েছে। ২০০২ সালে পল্লবী থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল মামুন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পল্লবী থানা বিএনপির ৯১ নম্বর ওয়ার্ড (সাংগঠনিক ওয়ার্ড) কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় তাকে। ছাত্র ও গণবিপ্লবে একদল স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে, যা কোনো সামান্য ব্যাপার নয়। কিন্তু স্বৈরশাসকরা গেলেও স্বৈরশাসনের ব্যবস্থাপনা যায়নি। আমলাতন্ত্র ঠিকই রয়ে গেছে, শুধু বড় রকমের একটা ধাক্কা খেয়েছে মাত্র। আমলাতন্ত্র কিন্তু কখনোই ক্ষমতা হারায় না। আইনের ম্যারপ্যাঁচে এভাবে যদি অপরাধীরা ক্ষমা পেয়ে যায় তবে তো আমরা আবারও ব্যর্থ হলাম।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্তত ছয়জন জামিনে মুক্তি পেয়েছে। তাদের বেশিরভাগই এক থেকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে ছিল। জামিনে মুক্ত হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে আছে ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, হাজারীবাগ এলাকার সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন। এ ছাড়া ঢাকার অপরাধজগতের আরও দুই নাম খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসুও কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। সিটি করপোরশেনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারের কাছে সুব্রত বাইনের প্রকাশ্যে আসার কথা জানানো হয়েছে। ঠিকাদারি কাজ করার আগে যেন তার বিষয়টি ‘খেয়াল’ রাখা হয়, এমন আওয়াজও দেয়া হয়েছে।

ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত খুনের আসামিরা এভাবে জামিন পেলে অন্য অপরাধীরা অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে। জামিনের সঙ্গে এসব ভয়ঙ্কর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোন ডিগ্রির সফলতা? কর্তৃপক্ষ কি ঠাওর করছিলেন তারা মুক্তি পেলে সাধু-সন্ন্যাসী-পীর বনে যাবেন? শীর্ষ সন্ত্রাসী, ডজন ডজনের কিলার ও চিহ্নিত জঙ্গিদের ছেড়ে দিলে তারা কি ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কবিতা লিখবে, আর ললিপপ চুষবে? আওয়ামী সরকারের পতনের পরই এসব কিলার ঢালাওভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে জামিন পেয়ে গেল? সরকার পতনের পর সব অপরাধী এক দিনেই ফেরেস্তা হয়ে গেল? যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর জেলের ভেতর থাকার কথা তাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, আর অন্যদিকে মানুষের নানামুখী নিরাপত্তার বাণী, সুখের দিনের কথা শোনানো—‘ইটস লুক ফানি’ নয় কী? এসব সিরিয়াল কিলারদের ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে বৈষম্য দূর করার মানসিকতা কার মাথায় চেপেছে! না ভাবছেন, স্বাধীন দেশে মানুষ আবার বন্দি থাকবে কেন? এছাড়া বর্তমান প্রজন্ম তো এসব কিলারদের শাসনামল দেখেনি। তাই একটা সুযোগ দেয়া হলো নাকি? ২নং স্বাধীন বাংলায় শীর্ষ সন্ত্রাসীও স্বাধীন! দেশ আবারও অস্থিতিশীল হোক—প্রশাসনের মধ্যে এমন চাওয়া কারও আছে কি না ভাবতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার বিষয়ে এত উদাসীন হলে চলবে কি? ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আমরা সবেমাত্র স্বৈরাচারমুক্ত হয়ে হুটহাট আবার সন্ত্রাসযুক্ত হলাম! আমাদের কি শান্তিতে বসবাসের সুযোগ হবে না?

২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম তৎকালীন সরকার ঘোষণা করেছিল, তাদের অন্যতম ছিল সুব্রত বাইন। তার নামে এখনও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। সুব্রতকে ধরিয়ে দিতে তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মতিঝিল, মগবাজার, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় এ প্রবণতা বেশি। ডিস-ইন্টারনেট ব্যবসা, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন, ফুটপাত, বাজার, ঝুট ব্যবসা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নির্মাণকাজ থেকে চাঁদাবাজি এবং জমি দখলের মতো বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা তোলা ও আর্থিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে অবস্থা বুঝে এখন রাজনৈতিকভাবে পরিচিতি পাওয়ার চেষ্টা করছে। এ কারণে রাজনৈতিক দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। এ কাজ ঠিকভাবে করতে না পারলে সামনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। তাই সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০