অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-৩০..
মিজানুর রহমান শেলী: স্বেচ্ছাসেবী আধা সামরিক বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে দায়িত্ব পালন ছিল রণদা প্রসাদ সাহার সৈনিক জীবনের হাতেখড়ি। তবে সৈনিক হিসেবে পৌরুষত্তম সত্য প্রদর্শনের সুযোগটি মূলত তিনি লাভ করেছিলেন বাঙালি পল্টনে যোগ দেওয়ার পর। এটা ছিল তার যুদ্ধজীবনের দ্বিতীয় ভাগ। ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকের কথা। এ সময় বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মাহতাব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনে বক্তৃতাকালে বাঙালি পল্টন বা বেঙ্গলি রেজিমেন্ট গঠনের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে থাকা বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সুন্দর উদাহরণকে পুঁজি করে, আমি মনে করি ভায়সরয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর লর্ড চেম্সফোর্ডের সঙ্গে দেখা করে বাঙালি পল্টন গঠনের আবেদন করা অথবা তা সম্ভব না হলে যত শিগগিরই সম্ভব অন্তত ব্রিটিশ অফিসারদের অধীন বাঙালিদের ভলান্টিয়ার কোর চালু করার জন্য আমাদের সমিতির একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা যৌক্তিক হবে। অন্যান্য সমিতিও এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে পারে। আমরা শুরুটা করতে আগ্রহী এবং এতেও আমরা সন্তুষ্ট থাকব। আমি দেখতে চাই যে, বাংলা ভারতের অন্য অংশের মতো সাম্রাজ্য রক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, যে সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে আমরা গঠিত।’ পরবর্তী সময়ে ‘নিউ ইন্ডিয়া’পত্রিকা এ প্রস্তাবের সমর্থনে একটি জোরালো প্রস্তাব রেখে ফিচার প্রকাশ করে। পত্রিকাটিতে উল্লেখ করা হয়, গ্রেট ব্রিটেন দেশের উত্তরাঞ্চলে সহিংস আন্দোলনরত হাইল্যান্ডারদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে সফলতা অর্জন করেছে। বাংলা থেকেও সেনাবাহিনী গঠন করে তারা সফলতা অর্জন করতে পারে। আধা সামরিক বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তারা বাঙালিদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ পদাতিক কমিটি গঠন করতে পারে। ফরাসিরা যদি বাঙালিদের যোদ্ধা হিসেবে সেনাবাহিনীতে নিয়ে লাভবান হয়, তবে ব্রিটিশ সরকার কেন লাভবান হবে না। দ্য বেঙ্গলি ও দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়টসহ আরও অনেক পত্রিকা এ বিষয়টি সমর্থন করে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছিল। যুবাদের মাঝে স্বাধিকার অর্জনের পর নিজেদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক প্রশিক্ষণে আগ্রহ তৈরি হয়। পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে যুবকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম হ্রাস পাবে এবং ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য বাড়বে বলেও মনে করা হচ্ছিল। তবে বিপ্লবীরা বিপ্লবের প্রয়োজনেই সেনাবাহিনীতে যোগদানের পক্ষে গ্রামগঞ্জে ধোঁয়া তুলে চলেছিল।
বাঙালি পল্টন গঠনের আন্দোলন বেগবান করতে ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমিটি’ নামে একটি বেসরকারি কমিটি গঠিত হলো। বিডন স্ট্রিটের এই কমিটির প্রধান ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা ও ডা. শরৎ মল্লিক। এই আন্দোলনে আরও ছিলেন রাসবিহারী ঘোষ, প্রিন্স ভিক্টর নারায়ণ, রাজা পিয়ারী মোহন মুখার্জি, স্যার মনিন্দ্রচন্দ্র সিনহা, মতিলাল ঘোষ, যোগেন্দ্র বোস, ডা. সুরেশ প্রসাদ সর্বাধিকারী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আরডি মেহতা, বিএন বসুসহ অনেকে। ডা. শরৎ কুমার মল্লিক অমৃতবাজার পত্রিকায় বাঙালি প্লাটুন গঠনের একটি খসড়া প্রস্তাব লেখেন ২৪ এপ্রিল তারিখে। পরে জুন মাসের প্রথম দিকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমিটির একটি প্রতিনিধি দল ফোর্ট উইলিয়ামের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আর জি স্ট্রাঞ্জের সঙ্গে দেখা করে। এই দলে ছিল সুরেন্দ্রনাধ ব্যানার্জি, ভুপেন্দ্রনাথ বসু, কুমার অরুণচন্দ্র সিনহা ও ডা. শরৎ। তাদের প্রস্তাবটি আর জি স্ট্রাঞ্জ সেনাবাহিনী সদর দফতরে পাঠিয়ে দেয়। এসব বিবেচনায় এনে সেনাবাহিনী বাঙালিদের নিয়ে একটি ডাবল কোম্পানি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এমন কানাঘোষা চলাকালেই ডা. মল্লিক জনবল সংগ্রহ শুরু করে দেয়।
এরপর ১৯১৬ সালের ৭ আগস্ট। এদিন বাঙালি পল্টন গঠনের সরকারি ঘোষণা হয়। এ ঘোষণাপত্র ৮ আগস্ট দ্য ইংলিশম্যান পত্রিকাটিতে ছাপা হয়েছিল। ১১ আগস্ট বিজ্ঞপ্তি ছাপা হলো। শুরু হলো সৈন্য সংগ্রহ। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, সরলাদেবী চৌধুরানী, মতিলাল ঘোষ প্রমুখ এ কাজটিকে সামাজিক কাজ হিসেবে নিয়েছিলেন। স্যার সুরেন্দ্রনাথ লিখেছেন তার ‘এ নেশন ইন মেকিং’ বইতে আমি শহর থেকে শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। যাতে আমার দেশের সম্পন্ন শ্রেণিগুলো উদ্দীপ্ত হয়; তারা বিপদগ্রস্ত সম্রাটের জন্য যুদ্ধ করে। আমি প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় ত্রিশটা সভায় বক্তৃতা দিয়েছি। সরলাদেবী চৌধুরানী তার বক্তৃতায় বলেন, শুনি নাকি তোমাদের অক্ষমতা এতদূর গড়িয়েছে যে, অন্ধকারে ঘরে চোর ঠুকেছে সন্দেহ হলে ভয়ে ভয়ে স্ত্রীকে টেনে বল ‘পিদিমটা জ্বালা’। …যে গভর্নমেন্ট তোমাদের অপৌরুষতার নেশা ধরিয়েছিল, সেই গভর্নমেন্ট আজ প্রায়শ্চিত্ত করতে প্রস্তুত। আজ তোমাদের হাতে শুধু কলম নয়, বন্দুক দিতে প্রস্তুত। লও সেই ভ‚ষণ, পুরুষালী সাজে সাজ, আমরা তোমাদের মায়েরা-বোনারা তোমাদের দেখে চক্ষু জুড়াই।
যাহোক, ১৭ আগস্ট সামরিক কর্তৃপক্ষ ফোর্ট উইলিয়ামে অবস্থিত ১২৭তম বালুচ লাইট ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল সি বি টেনারকে বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির সৈনিক নির্বাচনের জন্য রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেন। ২১ আগস্ট ফরিদপুরে সভা হয়। এখান থেকে সরকারকে ধন্যবাদ জানানো হয়। একইভাবে ২৮ ও ২৯ আগস্টে পাবনা ও দিনাজপুরে, ১ সেপ্টেম্বর বর্ধমানে, ৪ সেপ্টেম্বরে বরিশালে সভা করে রিক্রুটিং কমিটি করা হয়েছিল। তবে এর মাঝেই ২২ আগস্ট ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন হলে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ডা. মল্লিক ৩০০ দরখাস্ত পড়ার কথা ঘোষণা করেন। অবশেষে ২২৮ জনের বেঙ্গলি ডাবল কোম্পানি গঠন করা হলো। এ সময় বেতন বৈষম্য সংকট সৃষ্টি করেছিল।
পল্টনের নামকরণ করা হয় ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট। সংক্ষেপে ৪৯তম বেঙ্গলিজ। কোম্পানির প্রশিক্ষণ প্রথমে নওশেরায় এবং ১৯১৭ সালের জানুয়ারি থেকে করাচিতে অনুষ্ঠিত হলো। নওশেরায় রওনা হওয়ার আগে ৬ সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত নিযুক্ত ১৫০ সৈন্যকে নিয়ে কলকাতা টাউন হলে বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। দৈনিক পত্রিকাগুলোয় ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠানের বিবরণী প্রকাশ হয়। সেদিন টাউন হলের সাজসাজ রব যেন পুরো ভারতেরই অহঙ্কার বইয়ে এনেছিল।
১০০ জন নির্বাচিত সৈনিক বেলা ৩টায় টাউন হলে পৌঁছে তাদের পোশাক বদলে নেন। সবারই খাকি রঙের শার্ট-প্যান্ট পরা ছিল। তবে একেবারে নতুন যোগ দেওয়া সৈনিকরা ধুতি পরে সেদিন অনুষ্ঠান মাতিয়েছিল। এ সময় প্রথমেই সৈনিকদের ফুলমাল্যে ভ‚ষিত করা হয়। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. দেব প্রসাদ সর্বাধিকারীর বাণী ডা. এসপি সর্বাধিকারী পড়ে শোনান। এখানে তিনি এই কঠিন কাজের শুভকামনা করেন। সতর্ক ও উচ্চকিত করে বলেন, তাদের সাফল্যের সঙ্গেই রয়েছে জাতির সুনাম।
বিকাল ৪টায় কলেজ স্ট্রিট, বউবাজার স্ট্রিট ও গভর্নমেন্ট প্লেস ওয়েস্ট হয়ে কুচকাওয়াজটি বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে পতাকা ও তালপাতায় সাজানো টাউন হলে এসে পৌঁছে। সামনে দুটি ছেলের হাতে সাদা কাপড়ে লাল রঙে ‘দি বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ লিখা ছিল। ১২৭ বেলুচ রেজিমেন্টের বাদক দল এতে যোগ দেয়। দর্শক-জনতা চারদিক থেকে হেঁকে হেঁকে জড়ো হতে থাকে। একটি প্রাণের বিনোদ সেদিন আন্দোলিত হয়েছিল। ‘দি হিন্দু প্যাট্রিয়টে’ লেখা হয়, এই টাউন হলে এর আগে কখনও এত প্রাণের উচ্ছাস মেলেনি। কুচকাওয়াজে জনতা শামিল হয়েছিল। বাড়িঘর থেকে অভিনন্দন ভেসে আসে। মোড়ে মোড়ে সৈনিকদের মাল্যভ‚ষণ ও ফটোগ্রাফি করেছিল জনতা। সভা মঞ্চের সম্মুখে উপবিষ্ট সৈনিকদের উদ্দেশে ডা. মল্লিক ও গভর্নর কারমাইকেল উৎসাহ ও উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা দেন।
এরপর ১০০ জনের মধ্যে ৫১ জন সৈনিক তিন দলে ভাগ হয়ে ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নওশেরার উদ্দেশে রওনা হন। প্রথম দল ১২ সেপ্টেম্বরে রওনা দিয়েছিল। এই দলে ছিলÑজগদীশ বর্ধন, পুলিন মণ্ডল, যতীন বিকাশ, ফণী লাহিড়ী, রমাপতি ভট্টাচার্য, চিত্তরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, জীতেন পাণ্ডে, প্রবোধ চক্রবর্তী, সুধীর সেন ও শচীন রয়। ১১ সেপ্টেম্বর এই ১০ জনকে স্টার থিয়েটারে পুনরাই সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তারপর ১২ সেপ্টেম্বর ঝড়-বৃষ্টি মাথায় তুলে সৈনিক, অতিথি ও মা-বোনেরা হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত হন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমিটির আয়োজনে এক বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বিদায় জানানো হয়। বয় স্কাউট স্বেচ্ছাসেবকের দল দায়িত্ব পালন করে। চন্দন-দূর্বা দিয়ে মা-বোনেরা আশীর্বাদ করে। বন্দেমাতেরম গাওয়া হয়। ঠিক সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ট্রেন নওশেরায় ছেড়ে যায়।
পরবর্তী দল ২০ সেপ্টেম্বর হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা হয়। সেদিনও এমন বড়সড় বিদায় অনুষ্ঠান হয়েছিল। তৃতীয় দল ২২ সেপ্টেম্বর, চতুর্থ দল ২৬ সেপ্টেম্বর রওনা দেয়। ২৫ সেপ্টেম্বরও টাউন হলে আড়ম্বরপূর্ণ সংবর্ধনার আয়োজন ছিল। রেললাইনের পথে পথেও সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। লাহোরের সংবর্ধনা নিয়ে দি ইংলিশম্যান জমকালো বিবরণী দিয়েছিল। ২০ সেপ্টেম্বরে ময়মনসিংহ শহরের সূর্যকান্ত টাউন হলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ১৯ অক্টোবর ঢাকা বার লাইব্রেরিতে সৈনিকদের বিদায় জানানো হয়। এখানে ‘আল্লাহু আকবর’ ও বন্দেমাতেরম স্লোগানে ইউরোপিয়ান ও বাঙালিরা লাইনে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায়। চট্টগ্রাম থেকে ২৪ অক্টেবর নওশেরা বিদায় নেওয়ার আগে ২১ তারিখে বিভাগীয় কমিশনার নৈশভোজের আয়োজন করে।
১৯১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বরের মধ্যে ১৩টি দলে বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির মোট ২৫০ জন নওশেরা পৌঁছে। এরপর পল্টনের জনবল পূর্ণ হওয়ায় ১৫ নভেম্বর থেকে কলকাতা ও ঢাকা থেকে সৈন্য ভর্তির যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। ১৯১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর যখন বাঙালি পল্টন নওশেরা ত্যাগ করে, তখন এর সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩০০।
মেসোপটেমিয়া থেকে দায়িত্ব শেষে ফিরে আসা এবং বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের কয়েকজন সৈন্য সরাসরি বেঙ্গলি ডবল কোম্পানিতে যোগ দেয়। এই দলে ছিলেন রণদা প্রসাদ সাহা।
লেখক : গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com