ইসমাইল আলী: দেশের সাতটি সিটি করপোরেশনে মোট এক হাজার কিলোমিটার সড়কে সৌরবিদ্যুৎচালিত স্ট্রিট লাইট স্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ২০১৫ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা থাকলেও এখনও কাজ শুরু হয়নি। এর মধ্যে গত বছর ডিসেম্বরে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এতে এক হাজার কিলোমিটারের পরিবর্তে মাত্র ২২০ কিলোমিটার স্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হবে। তবে সে অনুপাতে কমানো হয়নি প্রকল্প ব্যয়। উল্টো কাজ না করলেও প্রকল্পটির গাড়ি কেনা হয়ে গেছে। সেগুলো ব্যবহারেও রয়েছে নানা অনিয়ম।
বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, প্রকল্পের আকার ৭৮ শতাংশ কমলেও ব্যয় কমানো হয়েছে মাত্র ২৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যা অযৌক্তিক। এছাড়া প্রকল্পের সুফলভোগী যেহেতু সিটি করপোরেশন তাই এর ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (আইআরআর) নির্ণয় করা যায়নি। অর্থাৎ প্রকল্পের জন্য ব্যয়িত অর্থ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কখনোই ফেরত পাবে না। ফলে সিটি করপোরেশনের জন্য এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ সমীচীন হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত সেপ্টেম্বরে এডিপি পর্যালোচনা সভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন পর্যালোচনার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রহমত উল্লাহ মো. দস্তগীর।
এতে বলা হয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও রংপুর সিটি করপোরেশনে মোট এক হাজার কিলোমিটার সড়ক সৌরবিদ্যুৎচালিত স্ট্রিট লাইট স্থাপনে ৩১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকায় প্রকল্প হাতে নেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে বছরে দুই কোটি ৭৮ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ সাশ্রয় হওয়ার কথা ছিল। এজন্য সরকারের তহবিল থেকে ৬৮ কোটি ২৮ লাখ ও সিটি করপোরেশনগুলো ১১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। বাকি ২৩৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা প্রকল্প সহায়তা চাওয়া হয়। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে শুরু করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। পরে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়।
নির্ধারিত সময়ে কাজই শুরু হয়নি প্রকল্পটির। পরে ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এতে এক হাজার কিলোমিটারের পরিবর্তে ২০ কিলোমিটার সোলার পিভি ও ২০০ কিলোমিটার নন-সোলার এলইডি স্ট্রিট লাইট স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে ২২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা চ‚ড়ান্ত করা হয়। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৫৪ কোটি ৬৭ লাখ ও সিটি করপোরেশন সরবরাহ করবে ১০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। বাকি ১৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রকল্প সহায়তা চাওয়া হয়েছে। চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) এক হাজার কিলোমিটারের পরিবর্তে ২২০ কিলোমিটার লাইটিংয়ের সংস্থান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ৭৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে প্রকল্পের আকার। তবে প্রকল্পের ব্যয় সে অনুপাতে হ্রাস পায়নি। মাত্র ২৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ কমানো হয়েছে প্রকল্প ব্যয়, যা খুবই অযৌক্তিক। এছাড়া প্রকল্পের আয়তন হ্রাস পাওয়ায় কতটুকু বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে, তা সংশোধিত ডিপিডিতে উল্লেখ নেই। যদিও প্রকল্পের আকার ৭৮ শতাংশ হ্রাস পাওয়ায় মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে।
এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বরে শেষ হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়েছে গত এপ্রিলে। এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছর এপ্রিলে। এছাড়া বাস্তবে সিটি করপোরেশনগুলোতে সরেজমিনে বাতি লাগানোর কাজ শুরু হবে আগামী এপ্রিলে। সুতরাং প্রকল্পের মেয়াদ আরও বাড়াতে হবে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিদ্যুৎ বিভাগ হলেও বাস্তবে পিডিবি কাজ করছে। প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে সরকারের সঙ্গে সাবসিডিয়ারি ঋণচুক্তি (এসএলএ) সই হয়নি। তাই প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে পিডিবির নাম অন্তর্ভুক্ত করে ডিপিপি সংশোধন ও এসএলএ সই করতে হবে।
প্রকল্পটি গ্রহণের আগে ২০১১ সালের জুনে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে আলোচ্য প্রকল্পের অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের ওপর সভা অনুষ্ঠিত হয। এতে বলা হয়, প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করতে পারে। এক্ষেত্রে পিডিবি শুধু কারিগরি সহায়তা দেবে। কিন্তু প্রকল্পে এখনও এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া সাত সিটি করপোরেশনে সাতজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ডিপিপি পুনর্গঠন হয়নি। এছাড়া এক প্রকল্পে সাতজন পরিচালক রাখা সুযোগও নেই।
প্রকল্পের অর্থ ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকল্পের সরঞ্জামাদি ক্রয়ে চুক্তি সম্পাদন হয়েছে গত ২৪ এপ্রিল। অথচ এ প্রকল্পের ১৮টি গাড়ি কেনা হয়ে গেছে ২০১৩ সালে। এর মধ্যে রয়েছে ৯টি জিপ ও ৯টি ডাবল কেবিন পিক-আপ। আবার প্রকল্পের অনুমোদিত জ্বালানি খাতের বরাদ্দকৃত অর্থ মূল কাজ শুরু আগেই ব্যয় হয়ে গেছে। এজন্য সংশোধিত ডিপিপিতে জ্বালানি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এদিকে সংশোধিত ডিপিপিতে উত্তরার ৪ ও ৬ নং সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত আছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ওই দুই সেক্টরে এরই মধ্যে আরসি বিতরণ পোলে ক্লাম দিয়ে স্ট্রিট লাইট সংযুক্ত রয়েছে। সেখানে নতুন পোল স্থাপন করা হলে শুধু অর্থের অপচয়ই হবে না, এলাকাবাসীর অসুবিধার সৃষ্টি হবে। তাই প্রকল্পে প্রয়োজনীয় সংশোধন প্রয়োজন।
প্রকল্পটির বাস্তবায়ন-পরবর্তী সমস্যাও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, বাতিসহ অন্য সরঞ্জামের ওয়ারেন্টি পিরিয়ড পাঁচ বছর। এগুলো সুনির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বিশেষ প্রকৃতির হওয়ায় পাঁচ বছর পর কোনো মালামাল নষ্ট হলে তা ওই কোম্পানি থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। এক্ষেত্রে ঠিকাদারের মনোপলি সৃষ্টি হবে। ফলে মেরামত ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। না হলে এগুলো মেরামত সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রহমত উল্লাহ মো. দস্তগীর বলেন, বিদ্যমান সমস্যাগুলো পর্যালোচনাপূর্বক প্রকল্পটির সুষ্ঠু বাস্তবায়নে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হবে। ডিপিপি সংশোধন করে পিডিবির নাম অন্তর্ভুক্ত ও এসএলএ সই করতে হবে। এছাড়া প্রকল্পটির ব্যয় অবশ্যই যৌক্তিক করতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্পের আকার কমানোয় কত বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে, তা নিরূপণ করতে হবে। এছাড়া বিদ্যমান স্ট্রিট লাইটিং ভালো থাকলে রুট সংশোধন ও নতুন রুট নির্বাচন করতে হবে।