সিপিডির হিসাব: দুই দফা বন্যায় ১৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি বছরে পরপর দু’বার বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। উপর্যুপরি এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় বিনষ্ট হওয়া রাস্তাঘাট, বাঁধ, অবকাঠামো এবং ফসল হিসাব করে এ তথ্য দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ বছরের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সিপিডি সংলাপে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। ‘বন্যা ২০১৭: ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্যোগ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার পর্যালোচনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এপ্রিল মাসে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকার বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তার কিছুদিন পরেই জুনের শেষ দিকে বর্ষা মৌসুমে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ৩২টি জেলায় ব্যাপক বন্যা হয়, যা আমন ধানসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।

পরপর সংঘটিত দুটি বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও পরবর্তী ভূমিকার বিষয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, ভুক্তভোগী এবং স্থানীয় প্রতিনিধিসহ স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আয়োজিত এ সংলাপের পরিচালনা করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। সিপিডির সিনিয়র গবেষণা সহযোগী মো. জাফর সাদিক ও ইশতিয়াক বারী এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত ও উপস্থাপন করেন। অন্যান্যের মধ্যে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান, পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত, কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. এম আসাদুজ্জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সংলাপের শুরুতেই সিপিডির প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে আরও বলা হয়, এ বছর দুটি বন্যায় মোট ৩৮টি জেলার ২৬৮টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মোট ২৭ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ গৃহস্থের আংশিক বা পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রায় সোয়া কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে হিসাব করেছে সিপিডি। গবেষণায় ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক হিসাবে বলা হয়েছে হাওরের বন্যায় ৪৬ লাখ ৭০ হাজার লোকের ১০ লাখ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার আর্থিক পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এছাড়া বর্ষা মৌসুমের বন্যায় গৃহস্থালির ক্ষয়ক্ষতি দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, বাঁধ ভেঙে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা এবং দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার ফসলহানি হয়েছে। এতে ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে বলে হিসাব করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।

এসব ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি এবং মধ্যমেয়াদি বিভিন্ন উদ্যোগের সুপারিশ করা হয় গবেষণায়। বলা হয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা পৌঁছাতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে সরকারকে। রাস্তা উন্নয়নের প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং এলজিইডির মধ্যে সমন্বয় করে যৌথ কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। এছাড়া বিশেষ অর্থায়ন স্কিম গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘অতিবৃষ্টির কারণে এবার বড় মাত্রায় বন্যা হয়েছে। তাছাড়া এটা সত্য, আমাদের নদীগুলোর নাব্য কমে গেছে। সরকার এখন ড্রেজিংকে গুরুত্ব দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বাজেটের অর্ধেকই ড্রেজিংয়ে ব্যয়ের সিদ্ধান্ত রয়েছে আমাদের। তবে স্থানীয় লোকজন বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকেন না। হাওরে কৃষকরা ফসল পরিবহনের জন্য বাঁধ কেটে ফেলেন, যা পরে মেরামত করা কঠিন। ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমার জনবল মাত্র ১০ জন। এটা অসম্ভব। আর কৃষকদের মন্ত্রণালয় থেকে বিআর-২৮ ধান চাষের অনুরোধ করা হয়। এটা স্বল্প সময়ে চাষ করা যায়, কিন্তু তারা বিআর-২৯ চাষ করেন, যা ৪০ দিন বিলম্ব ঘটায়। রিস্ক নেন তারা, আর দায়ভার নিতে হয় সরকারকে।’

তবে বন্যা ও বাঁধ ব্যবস্থাপনায় কিছুটা দুর্নীতি রয়েছে বলে স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি আছে, তবে তা বন্যার কারণ নয়। আমাদের কিছুটা গাফিলতিও ছিল। তবে বন্যার সার্বিক কারণ সেগুলো নয়। লুটপাটের বিষয়ে তিনি বলেন, লুট হলেও হরিলুট হয়নি। এ ছাড়া বাঁধের বাইরে চর দখল করে বসবাস শুরু করা লোকদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আলাদা বাঁধ নির্মাণ সম্ভব নয় বলেও দাবি করেন মন্ত্রী।

সভায় পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, সরকার ব্রহ্মপুত্র নদীর বাঁধে ভালো ব্যবস্থাপনা করেছে। কিন্তু কোথাও কোথাও বাঁধ নির্মাণের প্রকল্পে হরিলুটের ঘটনা ঘটেছে। বন্যার পরিস্থিতি শেষ হয়নি। পাউবোর আজকের পূর্বাভাস অনুসারে আগামীকাল (আজ) চুনারুঘাটে পানির স্তর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় উঠতে পারে। সুতরাং বন্যা পরিস্থিতি শেষ হয়নি।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০