মানবসম্পদ ও জিনতত্তে রণদা

অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-৪০

মিজানুর রহমান শেলী: উন্নয়নশীল পরিবেশে কোনো বাণিজ্যিক উদ্যোগের উন্নয়নে উন্নত দেশের ধারণা থেকে প্রশিক্ষণমূলক ও কারিগরি সহায়তা নেওয়ার প্রথা ও একাডেমিক ভিত্তি রয়েছে। উন্নত ব্যবসায় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি একজন সফল উদ্যোক্তার জীবন প্রণালি অনুসরণ করতেও পরামর্শ দেওয়া হয়। তারপর তরুণ উদ্যোক্তাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু রণদা প্রসাদ সাহার তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা ছিল না। পরিপ্রেক্ষিতও ছিল না বলতে হয়। তার জীবনে প্রশিক্ষণ পাওয়ার সময়টাই কেটেছে যুদ্ধ-বিগ্রহ আর জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। তাছাড়া ব্রিটিশ শাসন আমলে একটি ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে তোলার মতো প্রশিক্ষণ পাওয়াটাও ছিল দুষ্কর। তিনিও পাননি। কার্যত ব্রিটিশ প্রশাসন ভারতে প্রযুক্তিগত শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবহেলা করত, ব্রিটেনের বড় বড় কারখানার দক্ষ ব্যবস্থাপকদের থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগও তারা বন্ধ করে দিত; ফলে ভারতীয়দের শিল্প-কারখানা খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতায় মারাত্মক ক্ষতি সাধন হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বোম্বের টেক্সটাইল কারখানায় বেশিরভাগ লগ্নি ছিল ভারতীয়দের, অথচ সেখানে ম্যানেজেরিয়াল ও সুপারভাইজরি কমিটিতে ১৯২৫ সালে ছিল ২৮ শতাংশ ব্রিটিশ (১৮৯৫-এ ৪২ শতাংশ)। নিচের স্তরের কর্মচারীদের কাছ থেকে ঘুষ ও উৎকোচ নিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিত, যারা ছিল বেশিরভাগই অদক্ষ। সেখানে ম্যানেজার, সুপারভাইজার ও সাধারণ শ্রমিকের ভেতরে সম্প্রদায়, ভাষা ও শ্রেণি বৈষম্য সংকট সৃষ্টি করত। একইভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যেও সব শাখা-প্রশাখায় ছিল ইংরেজদের আধিপত্য এবং ভারতীদের দমিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র।

নৌ-পরিবহন খাতেও ছিল ব্রিটিশদের একক আধিপত্য। এর ভালো উদাহরণ হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লঞ্চ পরিবহন ব্যবসা। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে না ভাই, দিন দুঃখিনী মা যে তোদের এর বেশি আর সাধ্য নাই এমন সব স্বদেশি আবেগ তুঙ্গে। স্বদেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য। জমিদারপুত্র জ্যোতির তাই ব্রিটিশদের টক্কর দিতে লঞ্চ পরিবহন ব্যবসায় নামলেন। তখন কলকাতা থেকে বরিশাল পর্যন্ত সরাসরি লঞ্চ চলত। কোনো বাঙালির জাহাজ থাকতে পারে, এটা তখন কল্পনাতীত। তাই জ্যোতির জাহাজে বাঙালিদের উপচে পড়া ভিড়। মুহূর্তেই টিকিট শেষ। ব্রিটিশরা হতবাক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পেলেন স্বদেশিদের বাহবা। বরিশালে তাই ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে জ্যোতির জাহাজকে বরণ করা হলো। শুরু হলো ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র বৈধ বা অবৈধ। ব্রিটিশরা এক টাকা থেকে টিকিটের দাম কমিয়ে করল আট আনা। অর্ধেক ভাড়া। বাঙালির আবেগের পাশাপাশি টাকার মায়াও কম নয়। জ্যোতির জাহাজ ফাঁকা হয়ে গেল। ব্রিটিশদের জাহাজে টিকিট শেষ। জ্যোতি বাবু ঋণ নিয়ে জাহাজের ব্যবসায় নেমেছিলেন। এর মানে হলো বাবুর সুদ-আসলে এবার কড়াই গণ্ডাই গুনতে হবে। বাবা দেবেন্দ্রনাথই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ওপর বেশি ভরসা করতেন। তবে তিনি হাল ছাড়লেন না। অনেক লস হবে জেনেও তিনি ভাড়া আরও কমিয়ে ২৫ পয়সা করলেন। এবার জ্যোতির জাহাজ মানুষের ভিড়। যেন জাহাজখানিই হাবুডুবু খায়। ব্রিটিশরা দিল পাল্টা জবাব। বরিশাল-কলকাতা ঘুরে আসুন। টাকা লাগবে না। একদম ফ্রি। জমিদারপুত্রের আবেগ ফুরায় না। তিনি হার মানতে রাজি নন। তিনিও ফ্রি করে দিলেন। বাঙালি বাবুর জাহাজে চড়লে ভাড়া তো ফ্রি বটেই। সঙ্গে দুই বেলা খাওয়াও ফ্রি। সঙ্গে একটি গামছাও থাকছে ফ্রি! অবশেষে দুই কোম্পানির এ প্রতিযোগিতা জ্যোতি আবেগ আর লগ্নির লড়াইয়ে হারলেন। সর্বস্ব হারালেন। ব্যবসা গুটিয়ে নিলেন। ব্রিটিশরা জ্যোতির জাহাজ অবশেষে কিনে নিয়েছিল।

এই অসম যুদ্ধের যুগে রণদার মতো অগঠিত প্রান্তিক মানুষের পক্ষে শিক্ষা প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যবসায় নামা ছিল অকল্পনীয়। অবশ্য শেষের দিকে ব্রিটিশরা ট্যারিফ প্রটেকশন নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু তাতে বরাদ্দ চুক্তির মাধ্যমে নিজস্ব উদ্যোগে কারখানা তৈরি, স্পন্সর ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা অথবা গ্রাম্য কারখানা তৈরিতে প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হলো না। ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে কারখানা ও প্রযুক্তি শিক্ষায় যে সহায়তা দেওয়া হতো তা ছিল নগণ্য। অন্যদিকে নৌ-পরিবহনে ছিল ব্রিটিশের একক আধিপত্য। সেই খাতে কোনো ভারতীয়কে তারা সুযোগ দিতে চাইবে না, সেটাই স্বাভাবিক।

তবে সাহা পরিবারের সন্তান হিসেবে সম্ভবত রণদা প্রসাদ সাহা ব্যবসায় উদ্যোগে জেনিটিক্যালি একটি সুবিধা পেয়েছেন। মিড-মার্কেট ইকোনমিকস অ্যাট ওয়ারউইক বিজনেস স্কুলের জিই ক্যাপিটাল চেয়ার, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের প্রফেসর নিকস নিকলও এর সাক্ষাৎকার নেন ফর্বস ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ফিলিপ সল্টার। এক প্রশ্নের জবাবে নিকস নিকলও বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে জেনেটিক ফ্যাক্টরগুলো উদ্যোক্তার বিভিন্ন ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা অনুধাবনে প্রবণতা সৃষ্টি করে। গবেষণায় তারা বিপুল পরিমাণ আইডেন্টিক্যাল টুইন্স ও ফ্রাটারনাল টুইনস ব্যবহার করেন। তা থেকে তারা ব্যবসায় উদ্যোগে জিন ও পরিবেশের প্রভাব আবিষ্কারের চেষ্টা করেন।

আইডেন্টিক্যাল টুইনস তাদের সব জিন সরবরাহ করে। কিন্তু ফ্রাটারনাল টুইনস কেবল তাদের নিঃসঙ্গ জিনগুলো সরবরাহ করতে থাকে। ফলে বড় বড় টুইনগুলো জোটবদ্ধ হয়। সম্ভবত একেকটি টুইন হলো একেকটি উদ্যোক্তা। আর সহ-টুইনগুলোও তাই উদ্যোক্তা। ফ্রাটারনাল টুইনের জোড়া অপেক্ষা আইডেন্টিক্যাল টুইনের জোড়াগুলোর মধ্যে যে কোনো উদ্যোগের ক্ষেত্রে জেনেটিক ফ্যাক্টরগুলো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এমনকি উদ্যোক্তা বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকারীত্ব একটি প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে ৩০-৩৫ শতাংশ থেকে যায়। বাদবাকি ফ্যাক্টরসগুলো তাহলে কী? কার্যত জিন ফ্যাক্টরের পাশাপাশি পারিবৈশিক ফ্যাক্টগুলো বেশি প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। আর সত্যিই সেটাই দেখা যায় প্রতিটা ক্ষেত্রে। পারিবৈশিক ফ্যাক্টরগুলোই যে কোনো ব্যবসায় উদ্যোগের সুযোগ-সুবিধা উপলব্ধি বা নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করতে বেশি কার্যকর। আবার জিন ফ্যাক্টরগুলো উদ্যোক্তার উত্তরাধিকারীত্বে অনেক বৈচিত্র্য দেখায়। সেখানে কেবল পারিবৈশিক ফ্যাক্টরগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতেই জিন ফ্যাক্টরগুলো বেশি প্রবণতা দেখিয়ে থাকে।

রণদা প্রসাদ সাহার জিনগত বৈশিষ্ট্য তাকে ব্যবসাবৃত্তিতে যতটুকু প্রভাব দেখিয়েছিল, তার চেয়ে পারিবৈশিক পরিস্থিতি আরও বেশি মোক্ষ করে তুলেছিল তাকে ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণে। কেননা, ছোট বয়সে মিন্তি বা হোটেলের কাজ ও কুরিগিরির পাশাপাশি সে কয়লা কুড়িয়ে এনে ব্যবসা করেছেন। এটাকে আমরা তার জিন ফ্যাক্টর বলতে পারি। কিন্তু তিনি যৌবনে যুদ্ধে গেলেন, পরে চাকরি শুরু করলেন এবং তা থেকে ব্যর্থ হলেন। চাকরি জীবনের ব্যর্থতা এবং নতুন কোনো ভালো চাকরি না থাকায় তিনি ব্যবসা শুরু করেছেন। এটাকে অবশ্যই পারিবৈশিক ফ্যাক্টর বলতেই হয়। তারপর তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়িক সৃজনশীলতাও দেখিয়েছেন। এটাকে নিশ্চয় জিন ফ্যাক্টরের সঙ্গে পারিবৈশিক ফ্যাক্টরের সমন্বিত প্রভাব বলাই যৌক্তিক হবে।

 

গবেষক, শেয়ার বিজ

mshelleyjuÑgmail.com

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০